‘আঁটো’ পোশাকে মেয়েরা কেন, ম্যাচই ভেস্তে দিলেন মৌলবিরা

এখানে তালিবান নেই। নেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গিরাও। তবু এই ‘আধুনিক’ পশ্চিমবঙ্গেই কিছু মৌলবির আপত্তি শুনে মহিলাদের একটি ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দিল খোদ প্রশাসন! কর্তাদের ভয়, যদি আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দেয়! আর খেলা বন্ধের নিদান যাঁরা দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, সেই ধর্মগুরুদের বক্তব্য আঁটোসাঁটো পোশাক পরে খেলতে নামা এবং সেই খেলা দেখা, দু’টোই নাকি শরিয়ত-বিরোধী! মুখে এ কথা বলেও খেলা ভেস্তে দেওয়ার দায়টা তাঁরা অবশ্য চাপাচ্ছেন গ্রামবাসীদের উপরে। তবে মৌলবিদের দলে ভিড়ে বিডিও-র কাছে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যা।

Advertisement

বাপি মজুমদার

চাঁচল শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৫ ০২:৪২
Share:

এখানে তালিবান নেই। নেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গিরাও। তবু এই ‘আধুনিক’ পশ্চিমবঙ্গেই কিছু মৌলবির আপত্তি শুনে মহিলাদের একটি ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দিল খোদ প্রশাসন!

Advertisement

কর্তাদের ভয়, যদি আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দেয়! আর খেলা বন্ধের নিদান যাঁরা দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, সেই ধর্মগুরুদের বক্তব্য আঁটোসাঁটো পোশাক পরে খেলতে নামা এবং সেই খেলা দেখা, দু’টোই নাকি শরিয়ত-বিরোধী! মুখে এ কথা বলেও খেলা ভেস্তে দেওয়ার দায়টা তাঁরা অবশ্য চাপাচ্ছেন গ্রামবাসীদের উপরে। তবে মৌলবিদের দলে ভিড়ে বিডিও-র কাছে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যা।

ঘটনাস্থল: মালদহ জেলার চাঁচলের হরিশ্চন্দ্রপুরের চণ্ডীপুর। জাতীয় মহিলা দলের একাধিক খেলোয়াড় নিয়ে তৈরি কলকাতা একাদশ এবং উত্তরবঙ্গ একাদশের মধ্যে প্রদর্শনী ম্যাচটি হওয়ার কথা ছিল শনিবার। স্থানীয় যে ‘প্রোগ্রেসিভ ইয়ুথ ক্লাব’-এর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ওই ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল, তারা তথ্য জানার অধিকার আইনে ম্যাচ বন্ধের কারণ জানতে চেয়েছে। এবং তাৎপর্যপূর্ণ হল, সেই ক্লাবের সদস্যদের বেশির ভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। ক্লাবের সভাপতি রেজা রাজির আক্ষেপ, “এলাকার মেয়েদের খেলাধুলোয় আগ্রহ বাড়বে ভেবেই মহিলা তারকা খেলোয়াড়দের প্রদর্শনী ম্যাচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন এ ভাবে অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করল, ভাবতেই পারছি না।”

Advertisement

স্বভাবতই এই ঘটনায় অনেকের মনে পড়ে যাচ্ছে আরব দুনিয়ার হরেক মৌলবাদী ফতোয়ার কথায়। খেলাধুলো তো দূর, এককালে প্রকাশ্য রাস্তায় আফগান মেয়েদের চাবুক পর্যন্ত মারত তালিবানি পুলিশ। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই দেশেও পরিবর্তন তো এসেছে!

মাত্র বছর তিনেক আগে দিল্লিতে সুব্রত কাপে খেলতে এসেছিল কাবুলের একটি মেয়েদের স্কুলের ফুটবল দল। হিজাবে মাথা ঢেকে, ট্র্যাকসুটের লোয়ারে পা ঢেকে যারা বল নিয়ে দাপিয়েছিল অম্বেডকর স্টেডিয়াম। সেই স্কুল দলের অধিনায়িকা আনন্দবাজারকে জানিয়েছিলেন, তাঁদের যা কিছু খেলাধুলো, তা স্কুল চত্বর বা স্টেডিয়ামের মধ্যেই। কারণ, খোলা মাঠে খেলতে গিয়ে কয়েক বার ‘বিপদ’ হয়েছে। তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে (সৌজন্যে হামিদ কারজাই সরকার)।

চলে আসুন ইরানে। ‘নিষিদ্ধ’ পরিচালক জাফর পানাহি-র ছবি ‘অফসাইড’। বিশ্বকাপ ফুটবলের যোগ্যতা অর্জন পর্বে দেশের ম্যাচ দেখতে চায় একদল ইরানি মেয়ে। কিন্তু ধর্মের কাঁটাতারে খেলা দেখার অধিকারটুকুও তো নেই তাদের। গোটা ছবি জুড়ে চলে তাদের সংগ্রাম। পানাহির এই ছবি কিন্তু ইরানে দেখানো যায়নি। কিন্তু তাঁর বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।

এই দুই খণ্ডচিত্রের সঙ্গে কি এ বার পাল্লা দিল একবিংশ শতকের মালদহ?

জাতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার, বর্তমানে কলকাতা পুলিশের দলে নিয়মিত খেলা নৌসাবা আলম বলছেন, “একুশ শতকে এই ঘটনা ভাবাই যায় না। আমি ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে বড় হয়েছি। কিন্তু বাবা-মা আমায় খেলতে উৎসাহ দিয়েছেন। কখনও শুনিনি, শরিয়তে ফুটবল নিষিদ্ধ।” শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহারের কথায়, “শরিয়তি আইনে এ রকম কোনও ফতোয়া আছে কি না, জানা নেই। শরিয়তি আইন কতটা শাস্ত্রসম্মত, তা-ও জানি না। যে ঘটনা ঘটেছে, তা আসলে ধর্ম এবং সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির মেলবন্ধনের ফসল। এটা সমাজ ও দেশের জন্য ক্ষতিকর।”

শরিয়ত প্রসঙ্গে চণ্ডীপুর মসজিদের ইমাম মহম্মদ মকসুদ আলম অবশ্য বলছেন, “গ্রামবাসীরা এসে জানতে চেয়েছিলেন, খেলা দেখা যাবে কি না। আঁটোসাটো পোশাক পরে খেলা বা তা দেখা যে শরিয়ত-বিরোধী, সে কথা ওঁদের বলেছিলাম।” যদিও ম্যাচের উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, ইমাম নিজেই গ্রামবাসীদের ডেকে জানিয়ে দেন, মহিলাদের খেলার ব্যবস্থা যারা করছে আর যারা খেলা দেখবে, দু’দলই সমান দোষী। মীরাতুন নাহারের পাল্টা প্রশ্ন, “কোরানে তো বলা আছে, নারী-পুরুষ উভয়কেই এমন পোশাক পরতে হবে, যাতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ না পায়। কই, সেই ফতোয়া তো মানা হয় না!”

ইমামের দাবি, খেলা বন্ধে প্রশাসনের কাছে দরবার করেন গ্রামবাসীরাই। যদিও জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার মৌলবিদেরই একাংশ যান হরিশ্চন্দ্রপুরের বিডিও-র কাছে। এবং রশিদাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যা শাম্মি আখতারও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। সেই তৃণমূল সদস্যা দাবি করেন, “একটা সমস্যা হওয়ায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাকে যেতে হয়। যাতে সমস্যা মেটে, সেটাই দেখতে বলেছিলাম। আমি মোটেই মেয়েদের খেলাধুলোর বিপক্ষে নই।”

কী বলছেন প্রশাসনের কর্তারা?

বিডিও বিপ্লব রায়ের কথায়, “কিছু ইমাম এসে আমায় বলেন, ওখানে পির সাহেবের মাজার রয়েছে। তাই মহিলাদের খেলায় আপত্তি আছে।” মালদহের জেলাশাসক শরদকুমার দ্বিবেদীর বক্তব্য, “উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। পুলিশের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমস্যা হতে পারে ভেবে ম্যাচ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।” এসডিপিও (চাঁচল) কৌস্তভদীপ্ত আচার্যের অবশ্য দাবি, ম্যাচটির ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও আপত্তি ছিল। এটা শুধু পুলিশের একার বিষয় নয়।

স্থানীয় চিকিৎসক পীষূষকান্তি দাসের ভাগ্নি, হ্যান্ডবল ও বাস্কেটবল দলের জাতীয় অধিনায়ক তথা আকাশবাণীর ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার অনিতা রায়ের মাধ্যমেই জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাঁচলের ক্লাবটি। মহিলা দলের সঙ্গে আসার কথা ছিল অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত শান্তি আইচ মল্লিকের। খেলা পরিচালনার কথা ছিল ফিফা রেফারি অনামিকা সেনের। সব ভেস্তে গিয়েছে। অনিতা বলেন, “এই রাজ্যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, ভাবতেই পারছি না। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।” কলকাতা ময়দানে দাপিয়ে ফুটবল খেলেছেন বহু মুসলিম মেয়ে। এখনও খেলছেন। নৌসাবা, মেহেরুন্নিসা, রেহানা খাতুন, রোজিনা খাতুন। বজবজের রোজিনা এখনও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না “আমি নিজের ইচ্ছেয় ফুটবল খেলি, ধর্মের নামে কিছু লোক কেন তাতে হস্তক্ষেপ করবে?”

চাঁচলে যে এমন আগেও হয়েছে, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের প্রাক্তন কোচ কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার। শিলিগুড়ি থেকে ফোনে বলেন, “১৯৭৬ সালে আমরা চাঁচলে খেলতে গিয়েছিলাম। প্রথমে ছোট চুল দেখে দর্শকেরা আমাদের ছেলে ভেবেছিল। বিরতিতে যখন বুঝতে পারে মহিলারা ফুটবল খেলছে, তখন তাড়া করে। কোনও রকমে পালিয়ে এসে রাতের অন্ধকারে বাস ধরে বাড়ি ফিরেছিলাম।” মাঝখানে ৩৯টা বছর! সময়ের স্রোত বেয়ে কিছু কি আদৌ বদলায়? নাকি, বদলায় না কিছুই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন