মারধরের ঘটনার এক দিন পরেও আতঙ্কে দিন কাটছে মাথাভাঙার নিশিগঞ্জের নিশিময়ী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নির্মল সাহার। শনিবার স্কুলের মধ্যেই একদল যুবক তাঁর উপরে চড়াও হয়ে লাঠি দিয়ে মারধর করে। তৃণমূলের কর্মীরাই তাঁকে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ। তবে প্রধানশিক্ষক পুলিশের কাছে যে লিখিত অভিযোগ করেছেন, সেখানে কারও নাম উল্লেখ করেননি। তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বৃহস্পতিবার তাঁর বাড়িতে বসে প্রধানশিক্ষক বলেন, যে যুবকেরা তাঁকে মারধর করেছে তাঁদের নাম জানেন না বলেই অভিযোগেও তা উল্লেখ করেননি।
তবে নির্মলবাবু বলেন, “ওই যুবকদের নাম আমি জানি না ঠিকই তবে তাঁদের দেখলে চিনতে পারব। তাঁরা নানা সময় স্কুলে এসেছেন। স্কুলের আশেপাশে তাঁদের দেখা যায়।” এরপরে নির্মলবাবু বলেন, “যে ভাবে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে লাঠি দিয়ে তাঁরা মারছিলেন, তাতে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে মেরেই ফেলবে বলে মনে হচ্ছিল। পরে অন্য কিছু বাসিন্দা এগিয়ে এলে তাঁরা আমাকে ছেড়ে দেন।”
বিরোধী দলগুলির অবশ্য অভিযোগ, ফের হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কাতেই প্রধানশিক্ষক অভিযুক্তদের নাম বলতে চাইছেন না। ওই ঘটনায় পুলিশ অবশ্য কাউকে গ্রেফতার করেনি। পুলিশ জানিয়েছে, প্রধানশিক্ষক নাম করে কোনও অভিযোগ করেননি। মাথাভাঙার এসডিপিও গণেশ বিশ্বাস বলেন, “ঘটনার তদন্ত শুরু করা হয়েছে।”
ওই স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি সাবলু বর্মন। তিনি তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। সাবলুবাবু কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ২২ শ্রাবণ উপলক্ষে মাথাভাঙা তথ্য সংস্কৃতি দফতরের উদ্যোগে এবং স্কুলের সহযোগিতায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের কার্ডে সাবলুবাবুর নাম না থাকায় কিছু যুবক প্রধানশিক্ষকের উপরে হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। সাবলুবাবু অবশ্য ওই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এদিনও তিনি বলেন, “স্কুলে অভিভাবকেরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। আমি কিছু ক্ষণ পরে স্কুলে যাই। প্রধানশিক্ষককে মারধর করা হয়েছে কি না, জানি না। তবে তা হয়ে থাকলে অন্যায় হয়েছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের উচিত ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি অভিভাবকদের বক্তব্যও শোনা দরকার।” আজ, সোমবার স্কুল পরিচালন সমিতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই ঘটনায় ফাঁপড়ে পড়েছেন তৃণমূলের কোচবিহার জেলা নেতৃত্ব। দলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিচ্ছি।”
বিজেপি এই ঘটনায় রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। বিজেপি-র কোচবিহার জেলার সাধারণ সম্পাদক নিখিলরঞ্জন দে বলেন, “শাসক দলের ভয় তৈরি হয়েছে ওই শিক্ষকের মধ্যে। নানা জায়গার ঘটনা দেখে এটাই হওয়া স্বাভাবিক ছিল। পুলিশও কিছু করবে না। তাঁরাও ভীত। তাই রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে শিক্ষার পরিবেশ বলে কিছু থাকবে না।” সিপিএমের কোচবিহার জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা প্রাক্তন মন্ত্রী অনন্ত রায় বলেন, “গোটা রাজ্যে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। সে কারণেই ওই শিক্ষক আতঙ্কে রয়েছেন। যাঁরা তাঁকে মারধর করেছেন তাঁদের নাম প্রকাশ করলে ফের যদি আক্রমণ হয়, সে জন্য চুপ করে রয়েছেন।” ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সম্পাদক অবশ্য এ ব্যাপারে শিক্ষকদেরই দায়ী করেছেন। তিনি মনে করেন, শিক্ষকরা যত চুপ করে থাকবেন তত আক্রমণ বাড়বে। তিনি বলেন, “শিক্ষার উপরে আক্রমণ সব সময় হয়েছে। এখন বেশি হচ্ছে। এর জন্য কিছুটা হলেও দায়ী শিক্ষকরাই। আক্রমণের শিকার হয়েও তাঁরা কারও নাম বলবেন না। কোন রাজনৈতিক দল হামলা করল, তা বলছেন না। আর এ জন্যেই সাহস বেড়ে যাচ্ছে হামলাকারীদের।”
স্থানীয় তৃণমূলকর্মীদের অনেকেই অবশ্য প্রধানশিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন। তাঁদের দাবি, মিড ডে মিলে নিম্নমানের খাবার দেওয়া হয় ছাত্রছাত্রীদের। স্কুলে নির্মাণ কাজ চলছে, সেখানেও নিম্নমানের জিনিসপত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রধানশিক্ষক অভিভাবক এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেন বলে তাঁদের দাবি। প্রধানশিক্ষক অবশ্য দাবি করেছে, ওই অভিযোগ ঠিক নয়।