রোদের অভাবে ক্ষতির মুখে ইতিরা

গত মরসুমে আমসত্ত্ব তৈরি করে লাভের মুখ দেখতে পারেননি শঙ্করী দাস, ইতি দাস ও মমতা দাসেরা। তাই এ বার আমের অধিক ফলন দেখে গত বারের ঘাটতি মেটানোর আশায় ছিলেন তাঁরা। তাঁদের সেই আশায় জল ঢেলেছে বৃষ্টি। সাত দিন ধরে মালদহে কখনও মুষলধারে, কখনও আবার ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে।

Advertisement

অভিজিৎ সাহা

মালদহ শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৫ ০১:৫৭
Share:

বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে ট্রাঙ্কে রাখা হচ্ছে আমসত্ত্ব। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

গত মরসুমে আমসত্ত্ব তৈরি করে লাভের মুখ দেখতে পারেননি শঙ্করী দাস, ইতি দাস ও মমতা দাসেরা। তাই এ বার আমের অধিক ফলন দেখে গত বারের ঘাটতি মেটানোর আশায় ছিলেন তাঁরা। তাঁদের সেই আশায় জল ঢেলেছে বৃষ্টি। সাত দিন ধরে মালদহে কখনও মুষলধারে, কখনও আবার ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া এখন তাঁদের পক্ষে নেই। ফলে, ঘরেই পচে নষ্ট হচ্ছে আমসত্ত্ব। এ বারও লোকসানই হবে বলে জানিয়েছেন ইংরেজবাজারের কোতুয়ালি গ্রাম পঞ্চায়েতের আমসত্ত্ব কারবারীরা।

Advertisement

যেমন, তাঁরা জানিয়েছেন, বিগত বছর চড়া দামে আম কিনতে হয়েছিল। ফলে, লাভের মুখ তেমন দেখতে পাইনি। এবার প্রথম থেকেই আমের উৎপাদন ভাল হয়েছে। তাই দ্বিগুণ পরিমাণে আম কিনে আমসত্ত্ব তৈরির কাজ শুরু করেছিলাম। টানা বৃষ্টিতে আমসত্ত্ব রোদে দেওয়া যাচ্ছে না। ঢেকে রাখতে হচ্ছে। ঢেকে রাখার ফলে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমন আবহাওয়া চলতে থাকলে এ বারও লোকসানেরই মুখ দেখতে হবে।

যদিও আমসত্ত্বের জন্য এমন আবহাওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন উদ্যান পালন দফতরের কর্তারা। উদ্যান পালন দফতরের সহ অধিকর্তা রাহুল চক্রবতী বলেন, ‘‘গোপালভোগ আমের আমসত্ত্ব তৈরি প্রায় হয়ে গিয়েছে। এখন হিমসাগরের আমসত্ত্ব তৈরির কাজ চলছে। এমন আবহাওয়ায় আমসত্ত্ব ঢেকে রাখা ছাড়া উপায় নেই। সূর্য উঠলে সঙ্গে সঙ্গে রোদে দিতে হবে।’’

Advertisement

উদ্যান পালন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মে মাসের শুরু থেকেই আমসত্ত্ব তৈরির ধুম পড়ে যায় মালদহে। জেলার মধ্যে ইংরেজবাজারের কোতুয়ালি, আড়াপুর জোত, চণ্ডীপুর, কাঞ্চনপুর, সদানন্দপুর গ্রামের আমসত্ত্বের ব্যাপক চাহিদা। আর কম বেশি জেলার বিভিন্ন প্রান্তেই তৈরি হয় আমসত্ত্ব। গোপালভোগ আম পাকার সঙ্গে সঙ্গে আমসত্ত্ব তৈরির কাজে ব্যস্ত পড়েন প্রস্তুতকারকেরা। কারণ এর আমসত্ত্বের চাহিদা বাজারে খুবই। বিভিন্ন বাজারে গোপাল ভোগের আমসত্ত্ব বিক্রি হতে শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন চলছে হিমসাগর আমের আমসত্ত্ব। সব শেষে হয় ফজলি আমের।

এমন মরসুমে চরম ব্যস্ত থাকেন আমসত্ত্ব প্রস্তুতকারবারীরা। তবে এ বার বৃষ্টির জন্য বিপাকে পড়েছেন তাঁরা।

প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে,বিশেষ উপায়ে তৈরি করা হয় আমসত্ত্ব। বাগান থেকেই কাঁচা আম কিনতে হয়। পাকা আম কিনলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই কাঁচা আম কেনা হয়। বাড়িতে রেখে আম পাকাতে হয়। কার্বাইড দিয়ে চার দিন রাখতে হয়। চার দিন পর দু’দিন খোলা জায়গায় রাখতে হয়। এক বার আমের বোঁটা কেটে জলে ধুয়ে নিতে হবে। আরেক বার খোসা ছাড়িয়ে নেওয়ার পর ধুতে হবে। এর পর নেটের উপর আম ঘষে রস বের করতে হবে। তার পর বাঁশের তৈরি ডালায় পরিষ্কার কাপড় দিতে হবে। সেই কাপড়ের উপর প্রথমে হালকা করে আমের রসের আস্তরণ দিতে হবে। এক দিনে চার বার আধ ঘণ্টা পর পর আমের রসের প্রলেপ দিতে হয়। সেই প্রলেপ আট দিন ধরে দেওয়ার পর প্রস্তুত হয় আমসত্ত্ব। এর জন্য প্রয়োজন হয় চড়া রোদ। রোদে শুকনো ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। বৃষ্টি হলে চরম বিপাকে পড়তে হয় তাঁদের। কারণ হাওয়া বাতাস লাগলে আমসত্ত্ব রসিয়ে যায়। তাই বৈদ্যুতিক পাখা চালিয়ে শুকনোর কোনও উপায় নেই। বাঁশের ঢালা থাকায় আগুন দিয়ে শুকনো হয় না।

এই পদ্ধতি শুকনো হলে আমসত্ত্বের মান ভাল হয় না। কারণ, তা তেতো হয়ে যায়। প্রস্তুতকারকেরা জানিয়েছেন মান ভাল না হলে তেমন দাম পাওয়া যায় না। গোপালভোগের ১০০০ টাকা, হিমসাগরের ৮০০ টাকা এবং ফজলির ৪০০টাকা কেজি দরে পাইকারি বাজারে বিক্রি করা হয়। এ বার টানা সাত দিনের বৃষ্টিতে আমসত্ত্ব নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। এ দিন ইংরোজবাজারের কোতুয়ালিতে গিয়ে দেখা গিয়েছে কেউ একাধিক ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রেখেছে আমসত্ত্বের ঢালাগুলি। কেউ বাক্সের মধ্যে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রেখেছেন। কোতুয়ালির সাহাজালালপুর গ্রামে ২০টির মতো পরিবার আমসত্ত্ব তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

হাসি দাস ও শঙ্করী দাসেরা বলেন, ‘‘২০ বছর ধরে আমসত্ত্ব তৈরি করে আসছি। চলতি মরসুমে এক কুইন্ট্যালের বেশি আম কিনেছি। কারণ গত বার আমের দাম বেশি থাকায় তেমন আমসত্ত্ব তৈরি করতে পারিনি। এ বার ভেবেছিলাম বেশি করে তৈরি করে লাভ করব। কিন্তু বৃষ্টিতে এ বার সব শেষ করে দিল। আমসত্ত্ব অর্ধেক অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া ঘরে আমসত্ত্বের জন্য রাখা আমও পচে যাচ্ছে। প্রচুর টাকার ক্ষতি হয়ে গেলে। এমন অবস্থায় সরকারি তরফ থেকে সাহায্য না মিললে এই পেশা টেকানো দায় হয়ে দাঁড়াবে।’’

রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়া করণ ও উদ্যান পালন দফতরের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন, ‘‘এ বারই প্রথম চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি সরকারি মূল্যে আম কেনা হয়েছে। আমসত্ত্ব প্রস্তুতকারকদের সমস্যা হলে তা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন