রায়গঞ্জে ধর্মঘট সমর্থকদের হাতে সরকারি বাস ভাঙচুর। —নিজস্ব চিত্র।
বাম-বিজেপির ডাকা ধর্মঘটে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা স্বাভাবিক থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আলিপুরদুয়ার, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরে ধর্মঘট বিরোধীদের সঙ্গে গোলমালও হয়। তবে সরকারি অফিসে হাজিরার হার প্রায় স্বাভাবিক ছিল বলে প্রশাসনের দাবি। যদিও ধর্মঘট সমর্থকদের তরফে ওই দাবি ঠিক নয় বলে পাল্টা দাবি করা হয়েছে।
ধর্মঘট সমর্থকদের অভিযোগ, কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ অতিসক্রিয় হলেও বিরোধীরা আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ পেলেও কাউকে গ্রেফতার করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। যেমন, ধর্মঘট সমর্থকদের রক্ত ঝরেছে আলিপুরদুয়ারের ভাটিবাড়িতে। সেখানে অভিযুক্ত তৃণমূল। কেউ গ্রেফতার হয়নি। মালদহে তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলরকে ঢিলের ঘায়ে জখম করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন ২ জন বিজেপি সমর্থক।
তবে দার্জিলিং পাহাড় ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, মালদহ, আলিপুরদুয়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন লাগোয়া এলাকায় যান চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। বাগডোগরা বিমানবন্দর ছিল প্রায় স্বাভাবিক। সেখানে সাধারণ যাত্রী ও পর্যটকদের গাড়ি পেতে তেমন সমস্যা হয়নি।
এ দিন শামুকতলার ভাটিবাড়িতে সিপিএমের মিছিলে হামলা হলে অজিতকুমার ঘোষ ও দ্বিজদাস দেবনাথ নামে প্রবীণ দুই কর্মীর মাথা ফাটে। তৃণমূলের দশ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে শামুকতলা থানায় লিখিত অভিযোগ জমা করেছে। সিপিএমের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। তৃণমূলের অভিযোগ সিপিএম কর্মী সমর্থকরাই মিছিল করার নাম করে তাঁদের উপর হামলা চালিয়েছে। এতে তৃণমূলের চার কর্মী সমর্থক জখম হয়েছে। তাঁদের ভাটিবাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। তৃণমূলের তরফে চার সিপিএম কর্মীর বিরুদ্ধে শামুকতলা থানায় অভিযোগ জমা পড়েছে। আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটায় সিপিএমের জোনাল অফিসে তৃণমূলের হামলায় এসএফআই–এর জেলা সম্পাদক সফিকুল হক জখম হয়েছেন বলে অভিযোগ। তবে আলিপুরদুয়ারের মহকুমা পুলিশ আধিকারিক অম্লান ঘোষের কথায়, ‘‘ফালাকাটায় কোনও গণ্ডগোলের খবর ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।’’
শিলিগুড়িতে হাসমিচক এলাকায় সকাল থেকে বন্ধ পালনে রাস্তায় নেমে মিছিল করার জেরে সিপিএমের রাজ্য সভার প্রাক্তন সাংসদ সমন পাঠক, আরএসপি নেতা বিনয় চক্রবর্তী-সহ বাম নেতা কর্মীদের পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে বেলার দিকে বন্ধ সমর্থনে বিজেপি-র নেতা-কর্মীরা অনুমতি ছাড়া মিছিল করেছে অভিযোগে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। বাঘা যতীন পার্ক থেকে মিছিল করে রবীন্দ্রনগরের দিকে যাওয়ার সময় সুভাষপল্লিতে পুলিশ তাদের ৯ জনকে গ্রেফতার করে। শিলিগুড়ি থানা এলাকা থেকে বাম এবং বিজেপি মিলিয়ে এ দিন ৩২ জনকে এবং ভক্তিনগর থানা এলাকা থেকে ৩ জন বামকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে থানায় নিয়ে গিয়ে তাদের ব্যক্তিগত জামিনে ছাড়া হয়। তবে সদ্য পুর নির্বাচনে ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জিতে আসা বাম কাউন্সিলর পরিমল মিত্র এবং কয়েকজন বাম কর্মীদের অনেক ক্ষণ থানায় নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ।
মালদহে চাঁচল থেকে কলকাতাগামী বাসের চালককে নামিয়ে বেধড়ক মারধরকরা হয়েছে বলে বাম ও বিজেপি বন্ধ সমর্থকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার বন্ধের দিন সকালে চাঁচলের গোবিন্দপাড়া এলাকায় ৮১ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ গিয়ে ওই বাস চালককে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করায়। ওই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না হলেও চাঁচলের কলিগ্রাম পঞ্চায়েত দফতর ও চাঁচল-২ ব্লক অফিস খুলতে বাধা দেওয়ায় তিন বিজেপি সমর্থককে পুলিশ গ্রেফতার করে। পাশাপাশি রতুয়ার বাহারালে রাজ্য সড়ক থেকে অবরোধ হটাতে গিয়ে পুলিশ লাঠি চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মালদহ শহরে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ বিজেপি ও তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। জখম হয়েছেন তৃণমূলের জেলার কার্যকরী সভানেত্রী তথা ওই ওয়ার্ডের প্রার্থী প্রতিভা সিংহ। তাঁকে তৃণমূল কর্মীরা উদ্ধার করে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করান। প্রতিবাদে তাঁর অনুগামী বিজেপির জয়ী প্রার্থী সঞ্জয় শর্মার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। এই ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এই ঘটনায় ওই ওয়ার্ডের বিজেপির জয়ী কাউন্সিলরের দুই ভাই সহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
৯ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী বিজেপি প্রার্থী সঞ্জয় শর্মা বলেন, ‘‘মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুবাবু আমাকে তৃণমূলে সমর্থন করার কথা বলেছেন। উনি নিজের ফোন থেকে ফোন না করে অন্যের মাধ্যমে আমাকে এই প্রস্তাব দিয়েছেন। আর এই প্রস্তাবে রাজি হলে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে বলে প্রলোভন দেখিয়েছেন। আমি রাজি হইনি। পুরো বিষয়টি জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েছি।’’ মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘যাঁরা এমন কথা বলছেন, তাঁরা জানেন না আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তাই তাদের দলের কাউন্সিলরকে লোভ দেখানোর প্রশ্নই উঠে না।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের বারোদুয়ারি এলাকার ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি ও মালবাজার থেকে রায়গঞ্জগামী তিনটি সরকারি বাসে ঢিল ছুড়ে সামনের কাচ ভেঙে দিয়ে পালিয়ে যায় বলে অভিযোগ। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে যাত্রীসমেত বাসগুলিতে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের রায়গঞ্জ ডিপোতে পৌঁছে দেয়।
কোচবিহার শহরের বিভিন্ন এলাকায় অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। বেলা কিছুটা বাড়তেই অবশ্য বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু এলাকায় দোকানপাট খুলেছে। রাস্তায় বেসরকারি যানবাহনের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। তবে এনবিএসটিসি-র বাড়তি বাসও চলেছে। জেলার তুফানগঞ্জ, মাথাভাঙায় তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি। দিনহাটায় দোকানপাট বন্ধ ছিল। মেখলিগঞ্জে মিশ্র সাড়া মিলেছে। বিকেলে আলিপুরদুয়ার-মাথাভাঙাগামী একটি বাস কোচবিহারের কদমতলা এলাকায় ইটপাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করা হয়।
উত্তর দিনাজপুরের বারদুয়ারিতে ৪টি ও মালদহের গোবিন্দপাড়ায় ১টি বাস ভাঙচুরের ঘটনা হয়েছে। নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সুবল রায় বলেন, “এদিন ৬০০-র বেশি বাস চালানো হয়। তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় ৬টি বাস ভাঙচুর হয়েছে। ক্ষতির হিসেব করা হচ্ছে।”
জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, রাজগঞ্জ ছিল ছুটির মেজাজে। দোকানপাট খোলেনি। জলপাইগুড়ি শহরের দিন বাজার ছিল সুনসান। একই ছবি ছিল কদমতলা, শান্তিপাড়া, বউবাজার এলাকায়। সরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ খোলা থাকলেও উপস্থিতির হার ছিল সামান্য। আদালতে স্বাভাবিক কাজ হয়েছে। তবে বেসরকারি বাস রাস্তায় নামেনি। সরকারি বাসের সংখ্যাও ছিল কম। অটো, টোটো কম চলেছে রাস্তায়। জেলা বামফ্রন্ট আহ্বায়ক সলিল আচার্য বলেন, “ধর্মঘট সর্বাত্মক হয়েছে। পুলিশ অন্যায় ভাবে জলপাইগুড়ি শহর থেকে ৮৫ জনকে গ্রেফতার করেছে।” জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “মানুষ ধর্মঘটে সাড়া দেয়নি। শহর ও গ্রামে জনজীবন স্বাভাবিক ছিল।”
দক্ষিণ দিনাজপুরে বেসরকারি ক্ষেত্রে বন্ধের প্রভাব পড়লেও সরকারি ক্ষেত্র ছিল স্বাভাবিক। বালুরঘাটে বন্ধের সমর্থনে একমাত্র বিজেপিকে রাস্তায় নামতে দেখা যায়। সকালে বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক শুভেন্দু সরকারের নেতৃত্বে দলীয় কর্মীরা বালুরঘাটের উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের বাসস্ট্যান্ডের সামনে বাস আটকে রাস্তায় বসে পড়েন। উপস্থিত পুলিশ তাদের হটিয়ে দিলে সরকারি যাত্রীবাস চলাচল শুরু হয়। জেলা জুড়ে সরকারি অফিস, স্কুল, কলেজ খোলা ছিল। শহরের তহবাজারে মাছ ও সব্জি বাজারে স্বাভাবিক কেনাবেচা হয়েছে। তবে বালুরঘাটে সমস্ত ব্যাঙ্ক এবং আদালত বন্ধ ছিল।