‘একনায়ক’ নেই, পাহাড়ও রহস্যময়

বিমল গুরুং: বছর দু’য়েক হল আত্মগোপন করে আছেন বিমল গুরুং ও তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গীরা। আগের মতো একচেটিয়া কর্তৃত্ব না থাকলেও পাহাড়ে বিমলের প্রভাবকে অস্বীকার করার সাহস দেখায়নি কেউই।

Advertisement

শুভঙ্কর চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:০৪
Share:

টহল: ভোটের মুখে পাহাড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী। —নিজস্ব চিত্র।

পাহাড়, সমতল, চা বাগান, বনাঞ্চলের মতো দার্জিলিং কেন্দ্রের সমস্যা ও চাহিদাও বৈচিত্রে পরিপূর্ণ। রাজ্যের অন্য লোকসভা কেন্দ্রগুলির চেয়ে দার্জিলিঙের নির্বাচনী চরিত্র বরাবরই অনেকটা ভিন্ন। গোর্খাল্যান্ডের দাবি ও অন্দোলনে ভাটা পড়লেও পাহাড়ের স্থায়ী সমস্যা সমাধানের ‘রাস্তা’ নিয়ে নানা মুনির নানা মত সামনে এসেছে। তবে এ সবের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হল, দীর্ঘ দিন বাদে পাহাড়ে ‘একনায়কতন্ত্রে’র অবসান হয়েছে। কোনও এক সুবাস ঘিসিং বা বিমল গুরুংয়ের কথাতেই এতকাল পাহাড়ে ভোট হত। মোটামুটি ধরাই ছিল, ঘিসিং বা গুরুংয়ের মতেই পাহাড় মত দেবে। কিন্তু সেই মত এখন আর পাহাড় চলে না। পাহাড়ে বিভিন্ন দল, জাতি, সংগঠনের আওয়াজ জোরদার হয়েছে। সেই পরিবশে পাহাড় ভোটে কী মত দেবে, তা নিয়ে তাই রহস্য বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক, পাহাড়ের ভোটে প্রধান প্রসঙ্গগুলো কী কী?

Advertisement

বিমল গুরুং: বছর দু’য়েক হল আত্মগোপন করে আছেন বিমল গুরুং ও তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গীরা। আগের মতো একচেটিয়া কর্তৃত্ব না থাকলেও পাহাড়ে বিমলের প্রভাবকে অস্বীকার করার সাহস দেখায়নি কেউই। মুখ্যমন্ত্রী থেকে শীর্ষ বিজেপি নেতৃত্ব সবার বক্তব্যেই ঘুরে ফিরে এসেছে বিমলের নাম। পাতলেবাসে বিমলের বাড়িতে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা থাকলেও তাঁর ভিডিও বার্তার আহ্বানে এখনও মাঠ ভরছে পাহাড়ে। সেটাই চিন্তায় রেখেছে তৃণমূল ও বিনয় তামাং শিবিরকে। পাহাড়ে কার্যত সে ভাবে সংগঠন না থাকা বিজেপির অন্যতম ভরসা ‘বিমল ম্যাজিক’।

বিনয় তামাং: এক সময় বিমলের সংগঠন সামলানো বিনয় এখন ‘সরকারি ভাবে’ পাহাড়ের প্রধান। তৃণমূলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দার্জিলিং দখলে এ বারের লড়াই তাঁর কাছে কার্যত অস্তিত্ব রক্ষার। কঠিন হলেও অল্প সময়ের মধ্যে অনিত থাপাকে সঙ্গী করে ছক কষে সংগঠন মজবুত করেছেন। পাহাড়ের বহু ছোট ছোট সংগঠন ইতিমধ্যেই তাঁদের প্রার্থী অমর সিংহ রাইকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছেন। শান্তিকামী পাহাড়বাসীদের একটা বড় অংশ চাইছে বিনয়ের নেতৃত্বকে মজবুত করতে। দার্জিলিং জয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম সেনাপতি বিনয় এখন তৃণমূলের আশার আলো।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মমতার ভাবমূর্তি: তিনিই রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি দু-তিন মাস পর পরই পাহাড়ে আসেন। পাহাড়ি চড়াই উৎরাইয়ে হেঁটে কখনও রিচমন্ড হিল থেকে লালকুঠি গিয়েছেন বা ম্যালে দাঁড়িয়ে পর্যটক, স্থানীয় মানুষদের সুখ, দুঃখের খোঁজ নিয়েছেন। দীর্ঘ দিনের দাবি মেনে পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি, বিভিন্ন জনজাতির জন্য আলাদা বোর্ড তৈরি বা হোম স্টে ট্যুরিজমের প্রসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা মঞ্চ থেকেই নির্দেশ দিয়ে দ্রুত সমস্যা মেটাতে পদক্ষেপ করার কথা বলেছেন। এই সব কারণে রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁরা ‘কাছের লোক’ ভাবতে শুরু করেছেন। চরম বিরোধীরাও মুখ্যমন্ত্রীর কিছু কাজের প্রশংসা না করে পারেননি। এ বারের ভোটে মমতার সেই গ্রহণযোগ্যতা বিশেষ প্রভাব ফেলবে বলেই বিশ্বস্ত স্তরের আলোচনায় স্বীকার করেছেন বিজেপি ও বিমল শিবিরের অনেক নেতাই।

সমতলের ভোট: বিগত লোকসভা নির্বাচনগুলিতে যেমন পাহাড়ের ভোট একচেটিয়া ভাবে একটি পক্ষে যেত, এ বার যে তেমন সম্ভাবনা নেই তা মেনে নিয়েছেন সব দলের নেতারাই। পাহাড়ের ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সমতলের ভোট। সমতলের তিনটি বিধানসভার দু’টি কংগ্রেস ও একটি বামেদের দখলে। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ ও পুরসভাতেও ক্ষমতায় বামেরা। বিরোধীদের গড়ে কতটা ফুল ফুটবে তা নিশ্চিত নয় পদ্ম বা ঘাসফুল কোনও শিবিরই। সেক্ষেত্রে সমতলের ভোট কাটাকাটিতে শেষ পর্যন্ত কাদের ফয়দা হয় সেই অঙ্ক কষা শুরু হয়েছে।

মিরিক: মিরিক জয় পাহাড়ে তৃণমূলের কাছে ‘মডেল’। পাট্টা প্রদানের আশ্বাস পূরণ করে যে ভাবে মিরিক দখল করতে সক্ষম হয়েছে তৃণমূল, সেই ফর্মুলাতে এ বার প্রচার হয়েছে গোটা পাহাড়েই। মিরিকে অনেকটাই স্বস্তিতে থাকা রাজ্যের শাসক দল অন্যত্র কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেটাই দেখার।

চোপড়া: দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে থাকা উত্তর দিনাজপুর জেলার এই খণ্ডটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। হামিদুল রহমান তাদের দলে যোগ দেওয়ার পর থেকে একসময় কংগ্রেসের গড়ে এখন অনেকটাই শক্তিশালী তৃণমূল। এই অঞ্চলে বামেদেরও সংগঠিত ভোটও নেহাত খারাপ নয়। ক্ষমতা ফিরে পেতে কোমর বেঁধে নেমেছে কংগ্রেসও। এখন পর্যন্ত দার্জিলিং কেন্দ্রের এই এলাকা থেকেই সব থেকে বেশি গন্ডগোলের খবর পাওয়া গিয়েছে। দিনের শেষে এলাকার সাধারণ মানুষ বলছে চোপড়ায় ‘জোর যার মুলুক তাঁর’।

চা বাগান: চায়ের জন্য গোটা বিশ্বে প্রসিদ্ধ দার্জিলিং। এ বার পাহাড়ের চা বাগানের ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। তা বুঝতে পেরে বড়, ছোট থেকে নির্দল প্রার্থীদের প্রচারেও চা বাগান প্রসঙ্গ থাকছেই। মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীও চা-কে এড়িয়ে যেতে পারেননি। তবে অন্য ভোটের মতো এ বারের প্রচারে বাগান শ্রমিকদের উপস্থিতি সে ভাবে হচ্ছে না বলে স্বীকার করে নিয়েছেন পাহাডের নেতারা। বন্ধ বাগানে ভোট নিয়ে কোনও উৎসাহ নেই। বেশ কয়েকটি বাগানে ভোট বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে চা শ্রমিকরা এ বারে খানিকটা চুপ করে আছেন। ফলে চাওয়ালাদের মন কোন দিকে ঝুঁকে তা বুঝতে ঘাম ছুটছে পোড় খাওয়া নেতাদেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন