সম্প্রীতি: পুজোয় সাহায্য নিজাম ও তাঁর বাবার। ছবি: সন্দীপ পাল
জলপাইগুড়ি সেই কোন সকালে পূর্ণিমা তিথি পড়ে গিয়েছে। কিন্তু নিজামের দেখা নেই। অন্নভোগ সাজিয়ে পুরোহিত বসে। অবশেষে বেলপাতা নিয়ে এলেন নিজাম মহম্মদ। গুরু পূর্ণিমার দিন তারপরেই পুজো শুরু হয়েছিল মন্দিরে।
যে কোনও দিনই নিজাম বেলপাতা-দূর্বা তুলে না আসা পর্যন্ত পুজো শুরু হয় না জলপাইগুড়ির দেবী চৌধুরানি কালী মন্দিরে। বড় ভোগের দিন পেল্লায় পিতলের হাড়ি ধুয়ে দেন নিজামের বাবা চান্দু মহম্মদ। বাবা-ছেলে দু’জনে প্রসাদও বিলি করেন। সকালে পুজোর জবাও তুলে দেন চান্দু। নিষ্ঠাবান মুসলিম। রোজ মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়েন। তবে স্নান না করে কালী মন্দিরেও ঢোকেন না। এ ভাবেই দু’দশক পার। বসিরহাট-বাদুড়িয়ার ছায়া পড়েনি জলপাইগুড়ির মন্দিরে।
পুরোহিত সুভাষ চৌধুরী বলেন, ‘‘কত লোক আসে মন্দিরে, সকলেই জানেন জোগানদাররা মুসলিম। কেউ কোনও দিন আপত্তি করেনি। মন্দির কমিটিও কোনও বাধা দেয়নি।’’
কথিত রয়েছে, দেবী চৌধুরানি এই মন্দিরে এসে পুজো দিতেন। সুভাষবাবুর দাবি, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ভবানী পাঠকও এক সময়ে এই মন্দিরে পুজো করতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। জলপাইগুড়ি পুর এলাকার সীমানা ছুঁয়ে থাকা জাতীয় সড়কের পাশে গাছগাছালি ঢাকা এই মন্দিরে একসময়ে গা ছমছম পরিবেশ ছিল। এখন মন্দির কলেবরে বেড়েছে। ঝোপঝাড় নেই, বিভিন্ন তিথিতে প্রচুর ভক্তসমাগমও হয়। কেউ পুজো দিতে আসেন কেউ বা পুরোনো মন্দিরের স্থাপত্য, শত বছর পুরোনো বট, অশ্বত্থ, রুদ্রাক্ষ গাছ দেখতেও আসেন। মন্দির লাগোয়াই বাড়ি চান্দু মহম্মদের। এক সময়ে সাফসুতরো করার জন্য মাসে দেড় হাজার টাকা পেতেন মন্দির কমিটি থেকে। এখন সে কাজ করেন তাঁর ছেলে। তবু মন্দিরে আসা ছাড়েননি।
মঙ্গলবার সকালে গিয়ে দেখা গেল হাতে পিতলের থালা নিয়ে পুজোর জন্য ফুল তুলেছেন চান্দু। চান্দুর ছেলে এ দিনও বেলপাতা আনতে দেরি করেছে। সদ্য তরুণ নিজাম জানাল, যে দেওয়ালে উঠে বেলপাতা পাড়তে হয়, বৃষ্টিতে তা খুব পিছল। রীতিমতো প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ফুল এনেছেন তিনি। নিজাম বলে, ‘‘একা ঠাকুরমশাই সব পেরে ওঠেন না। তাই একটু সাহায্য করি।’’ লাল ধুতি পরা, কপালে রক্ত চন্দনের টিপ আঁকা পুরোহিত সুভাষবাবু বললেন, ‘‘আর কাউকে ভরসা করা যায় না। কোথা থেকে কী এনে দেবে! নিজামকে চোখ বুজে ভরসা করা যায়।’
মঙ্গলবার দুপুরে পুজোর ফুল সাজিয়ে দিয়ে উঠে পড়লেন বছর ষাটের চান্দু। মন্দিরের দেওয়াল ঘড়িতে চোখ রেখে চলার গতি বেড়ে গেল। মসজিদে যেতে হবে। দুপুরের নামাজের সময় হচ্ছে!