আশ্বিনের আকাশ নীল, তার আলোময় রঙের পাশে গত চার পাঁচ দিন ধরেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস আচমকা যেন ঘাড়ে ফুঁ দিতে দিতে ঝুঁকে পড়ছে। সময় হয়েছে পরিযায়ী পাখিদের আসার। হেমন্ত আর শীতে তারা পড়শি হয়ে বসত করে। তাদের সঙ্গে সঙ্গেই আশ্বিনের আকাশে হেমন্তের আমেজ আসে। আসে হিম। আসে আকাশপ্রদীপের সময়। রাতের বেলাতেও ঝকঝক করে নক্ষত্র ভরা আকাশ। পৃথিবীর দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকে কালপুরুষ।
রাত পোহালেই লক্ষ্মীদেবীর আবির্ভাব। মস্ত গোল গোল চোখের আদুরে প্যাঁচাটিকে নিয়ে এসে পড়লেন তিনি। আরও একবার কালীপুজোর দিন পূজিত হবেন মহালক্ষ্মী রূপে। আমাদের পুজো ছিল সেটাই। তাই কোজাগরী পুজোর স্মৃতি বলতে মামাবাড়ি পূর্ণিয়ার। তাৎমাটুলি থেকে শুঁয়োপোকা ভরা পদ্মবনের সদ্য ছেঁড়া পদ্মের স্মৃতি, শিউলিতলায় ভোররাতে শিশির মাখা কমলা বোঁটা ফুল কুড়নো আর বড়মামীর হাতে চাল গোলা ন্যাকড়়ায় টানা সুচারু লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ বাড়ির এ মাথা ও মাথা হয়ে তুলসিতলা ছাড়িয়ে শান বাঁধানো উঠোন পেরিয়ে স্থলপদ্ম, আম, সুপুরির নীচে ঘেরা ছোট্ট জলাশয়ের সামনে গিয়ে থামতো। বাবা ফল কাটতে বসতেন মা, মামীদের সঙ্গে। সঙ্গে লাগো লাগো সময়ে ঠাকুরমশাই আসতেন। আমাদের অপেক্ষা পুজো শেষের লুচি পায়েস, মোয়া, মুড়কি।
পূর্ণিয়ায় বরিশালি আত্মীয়েরা এ ওর বাড়ির পুজোয় ঢুঁ মারতো। একটু সন্ধে গড়ালে তুতো ভাইবোন মিলে বারিহাটের মেলায় যেতাম। সেখানে লক্ষ্মীদেবী এমন গৃহলক্ষ্মী বা ঘটাশ্রিত নয়। পেল্লাই গোলাপি শলমা চুমকির দেবী এক্কেবারে ক’দিন আগের দুগ্গামার মতো। ওই বারিহাটের মেলা থেকে ঠিক রথযাত্রার মতো মাটির থ্যাবড়া পুতুল কিনে ঘর ভরাতাম। মনে পড়ে মামাবাড়ির ছাদে পুজোর আগে বা পরের রাত জাগা। শিশির মোছা চাঁদের সাদা আলো ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠত বাড়ির পিছনে দীর্ঘ শিমূল গাছের মাথায়। আরও পিছনে নীলকর সাহেবদের সমাধিভূমিতে সেই আলো স্পষ্টভাবে আয়নার মতো ঝকঝক করলে আশপাশের গাছের ভুতুড়ে পেঁচারা তাদের সাদা খয়েরি ডানা নিয়ে ওড়াওড়ি শুরু করত। ঠান্ডার চাদর মশারির মতো ঘিরে নিত আর কখন যে তিনতলার ছাদ পেরিয়ে বিছানায় ঢুকে গেছি মনেই পড়ত না!
আরও একটি লক্ষ্মীপুজো এল। চলেও যাবে। লক্ষ্মীমন্ত মেয়েদের ছোট্ট ছোট্ট পায়ের ছাপে আমরা যেন তাদের এ বার লক্ষ্মীমেয়ের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীমানুষও মনে করি, তবেই দেবী সন্তুষ্ট হবেন। কড়ির বাঁশির ভিতর মা যে অর্থ সঞ্চয় করতে শেখান, তা যেন শুধু মেয়ের বিয়ের জন্য নয়, বিদ্যার্থেই খরচ হয়। স্থানে স্থানে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর তেমন বিরোধ নেই, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাঁরা এক ও অদ্বিতীয়া।