ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়ানো কোটিপতি ব্যবসায়ীকে দেখে চলছে নানা গুঞ্জন। কেউ বলছেন, লোকদেখানো! আবার কেউ বলছেন, ‘‘ওদের তো বড় নোট, তাই খুচরোর জন্য লাইন দিয়েছেন।’’
অতি পরিচিত ওই ব্যবসায়ীর একটি ইটভাটাও রয়েছে। ঘণ্টা দু’য়েক লাইনে দাঁড়িয়ে দু’হাজার পেয়েই ছুটলেন ইট ভাটায়। উদ্দেশ্য, ১০০ টাকা করে দিয়ে ২০ জন শ্রমিককেও যদি আটকানো যায়। অন্য এক ব্যবসায়ী আবার চালের গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন ইট ভাটায়। টাকার বদলে বুঝিয়ে চাল দিলেন তাদের।
অথচ এক সপ্তাহ আগেও ছবিটা অন্যরকম ছিল। পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে প্রতিটি ইট ভাটায় কয়েকশো শ্রমিক। প্রত্যেকেই কাঁচা ইট তৈরিতে ব্যস্ত। এক হাজার ইট তৈরি করতে পারলেই মিলবে সাড়ে পাঁচশো টাকা।
নভেম্বরে ইট তৈরির মরসুম শুরু হওয়ার পর প্রতিটি ইট ভাটাতে এমনই ব্যস্ততা থাকে। কিন্তু এবার কাঁচা ইট তৈরি শুরু হতেই অচল নোটের গেরোয় সেই ছবিটা বেমালুম বদলে গিয়েছে মালদহের চাঁচল মহকুমার ইট ভাটাগুলিতে।
মহকুমায় ৫১টি ইট ভাটা রয়েছে। মালদহ এবং দুই দিনাজপুর তো বটেই, শিলিগুড়িতেও চাঁচলের ইটের চাহিদা রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাতে জড়িত অন্তত ২৫ হাজার মানুষ। কিন্তু মজুরি না পেয়ে শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ায় বহু ইট ভাটা বন্ধের মুখে। ভরা মরসুমেও তাই খাঁ খাঁ করছে ইট ভাটাগুলি। উপরের দুটি ঘটনা চাঁচল ও হরিশ্চন্দ্রপুরের দুই ব্যবসায়ীর শ্রমিকদের রোখার মরিয়া চেষ্টার দুটি নমুনা মাত্র। মালিকদের পাশাপাশি সপ্তাহ শেষে মজুরি না পেয়ে চূড়ান্ত দূরবস্থা দিন আনি দিন খাই শ্রমিকদেরও।
উত্তর মালদহ ব্রিকফিল্ড ওনার্স সমিতির কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের পাশাপাশি শ্রমিকরাও দুর্দশায় পড়েছেন। শ্রমিকের অভাবে ইট ভাটাগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’’
সমিতি সূত্রেই জানা গিয়েছে, অক্টোবরের শেষ থেকে ভাটাগুলিতে কাঁচা ইট তৈরি শুরু হয়। নভেম্বরের শেষে ভাঁটায় ফায়ারিং তথা আগুন দেওয়া হয়। প্রতিটি ইট ভাটাতেই গড়ে দু’শো থেকে তিনশো শ্রমিক কাজ করেন। স্থানীয় হাটবারের দিন ওই শ্রমিকদের সপ্তাহান্তের মজুরি মেটানোই নিয়ম।
ইট ভাটাগুলিতে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য গড়ে এক থেকে তিন লক্ষ টাকার বন্দোবস্ত করতে হয়। কিন্তু ভাটার মালিকরাই জানাচ্ছেন, শ্রমিকরা পুরনো নোট নিচ্ছেন না! সেই টাকা তারা ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছেন! কিন্তু ব্যাঙ্কগুলি থেকে যে টাকা দেওয়া হচ্ছে তাতে একদিনের মজুরিও মেটানো সম্ভব নয়।
শ্রমিক সমস্যায় বন্ধের মুখে পড়া চাঁচলের একটি ইট ভাটার মালিক আখতার হোসেন বলেন, ‘‘মজুরি না পেয়ে শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে চলে দিয়েছেন। টাকা না পেলে ওদেরই বা চলবে কি করে।’’
হরিশ্চন্দ্রপুরের একটি ইট ভাটার শ্রমিক নরেন সিংহ বলেন, ‘‘মালিকদের সমস্যাটা বুঝি। কিন্তু কাজ করে টাকা না পেলে আমাদের তো না খেয়ে মরতে হবে।’’ একই অবস্থা সদরপুরের মহম্মদ আলম, টিকাচারের কিরণ সিংহদের মতো শ্রমিকদের।