বসেই কাটে সারা দিন, দেখা নেই রোগীর

অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা বসে রয়েছেন। কিন্তু রোগী নেই। গত দু’মাসে ডাবগ্রামে শিলিগুড়ি পুরসভার মাতৃসদনের রোগী ভর্তি এত কমে গিয়েছে যে কাউকেই অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যেতে হয়নি। ফলে সকাল-সন্ধেয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে বসে থাকা ছাড়া কাজ নেই চালকদের।

Advertisement

সৌমিত্র কুণ্ডু l

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:০৭
Share:

অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা বসে রয়েছেন। কিন্তু রোগী নেই।

Advertisement

গত দু’মাসে ডাবগ্রামে শিলিগুড়ি পুরসভার মাতৃসদনের রোগী ভর্তি এত কমে গিয়েছে যে কাউকেই অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যেতে হয়নি। ফলে সকাল-সন্ধেয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে বসে থাকা ছাড়া কাজ নেই চালকদের।

রাতে যে চালক থাকেন তিনি ১২টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে থেকে বাড়িতে চলে যান। রোগী না থাকলে নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসকেরও কাজ নেই। বসে থেকে গল্প করেই সময় কাটছে তাঁদের। রোগী না থাকলে চিকিৎসক কোয়ার্টারে চলে যান। আচমকা রোগী এসে পড়লে তখন খবর দিলে তিনি আসেন।

Advertisement

আগে যেখানে রোগীর ভিড় লেগেই থাকত, এখন সেখানে উল্টো দৃশ্য। ১৬টি শয্যার মধ্যে দু’টিতে রোগী রয়েছে। বাকি সব ফাঁকা। কখনও কোনও রোগীই থাকেন না। অন্য দিনগুলিতে কখনও চারটে, পাঁচটার বেশি রোগী থাকছে না অন্তর্বিভাগে। শয্যাগুলির একাংশ ধুলোয় ভরা। গত দু’বছর ধরে অস্ত্রোপচার করে প্রসব ব্যবস্থা এখানে বন্ধ রয়েছে। সরকারি প্রকল্পে নিখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা পাচ্ছেন না দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা বসবাসকারীরা। একমাত্র রেসিডেন্সিয়াল মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) নিরঞ্জন মণ্ডল অসুস্থ হলে বা ছুটিতে থাকলে বহিবির্ভাগ বন্ধ হয়ে থাকে। বন্ধ্যাত্বকরণের চিকিৎসাও মাস খানেকের উপর বন্ধ হয়ে রয়েছে। সাধারণ প্রসবের ক্ষেত্রে যে কয়েক জন প্রসূতি ভর্তি হন, রোগী বলতে তাঁরাই।

গত বিজয়া দশমী থেকে অসুস্থ থাকায় চিকিৎসক নিরঞ্জনবাবু দিন পাঁচেক কাজে আসতে পারেননি। ওই দিনগুলিতে মাতৃসদনের অন্তবির্ভাগের রোগীদের রেফার করে অন্যত্র পাঠিয়ে দিতে হয়েছে।

এক দু’জন রোগী থাকলে বা কেউ ভর্তি না থাকলে কী করেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা? এক জন আরএমও চিকিৎসক ছাড়াও অন্তর্বিভাগের জন্য ৫ জন নার্স রয়েছেন। ৪ জন মহিলা স্বাস্থ্য কর্মী এবং দুই জন পুরুষ স্বাস্থ্য কর্মী, ২৪ ঘণ্টার জন্য নিরাপত্তা রক্ষীরা থাকছেন। তেমন কাজ না থাকায় তাঁরা কার্যত বসে বসেই বেতন পাচ্ছেন বলে অভিযোগ। নিরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘রোগী না থাকলে বসে থাকতে হয়। তবে কাজের সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতেই হয়।’’ দু’জন চিকিৎসেকর কাজ তিনি নিজেই দেখেন বলে দু’জনের বেতন মাসে ৩০ হাজার টাকা করে তিনি পাচ্ছেন। কী করে তা দেওয়া হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে?

মেয়র অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ন্যাশনাল আর্বান হেল্থ মিশন প্রকল্পের অধীনে মাতৃসদনের চিকিৎসা পরিকাঠামো ঢেলে সাজা হবে। ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করা হবে। দ্রুত পরিষেবার মান উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’ তিনি জানান, বছর দুয়েক আগে বন্ধ্যাত্বকরণের কাজ করতে গিয়ে এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনার পর চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। সেই চিকিৎসক চলে যান। তার পর থেকেই একজন আরএমও চিকিৎসক রয়েছেন।

গত তিন বছর ধরে একে একে অনেক পরিষেবাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে শিলিগুড়ির ডাবগ্রাম এলাকার মাতৃসদনটিতে। বহির্বিভাগে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে ১ জন শিশু বিশেষজ্ঞ, ১ জন চিকিৎসক, প্রসূতি বিভাগের ৩ জন চিকিৎসক রয়েছেন। সপ্তাহের বিভিন্ন দিন তাঁরা পালা করে আসেন। সেই মতো পরিষেবা দেন। অন্তর্বিভাগে প্রসূতিদের চিকিৎসা পরিষেবার জন্য দু’জন আরএমও থাকার কথা। অথচ এক জন থাকায় তাঁকেই সমস্ত কিছু দেখভাল করতে হচ্ছে। শল্য চিকিৎসক না থাকায় সদ্যোজাতের জন্ম দিতে প্রসূতি মহিলাদের অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে রয়েছে। অভাব রয়েছে উপযুক্ত পরিকাঠামো ও অত্যাধুনিক যন্ত্রেরও। সাধারণ ভাবে শিশুর জন্ম না হলে রেফার করে দিতে হচ্ছে শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতাল বা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে। তাই এখানে চিকিৎসা করাতে উৎসাহ হারাচ্ছেন অনেকেই।

পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ দুর্গা সিংহ বলেন, ‘‘শীঘ্রই এক জন মহিলা শল্য চিকিৎসক কাজে যোগ দেবেন। দ্রুত পরিষেবা চালুর চেষ্টা চলছে। অন্য সমস্যা মেটাতেও আমরা উদ্যোগী।’’

মাতৃসদন সূত্রেই জানা গিয়েছে, আগে মাসে শতাধিক প্রসূতির চিকিৎসা হত। এখন সেখানে অর্ধেকেরও কম রোগী হয় অন্তর্বিভাগে। এক সময় আইপিপি-এইট প্রকল্পের অধীনে ছিল মাতৃসদনের চিকিৎসা পরিষেবা। বর্তমানে আর্বান প্রাইমারি হেল্থ কেয়ার সার্ভিসেস প্রকল্পের অধীনে ওই কেন্দ্র চলে। আয়ুষ্মতী প্রকল্পে বিপিএলভুক্ত পরিবারের সদস্য এবং তফসিলি জাতি উপজাতির প্রসূ্তিরা নিখরচায় এখানে চিকিৎসা পেতে পারেন। কিন্তু তা বন্ধ রয়েছে। পুর কর্তৃপক্ষ জানান, বিষয়টি নিয়ে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা। প্রকল্প চালু করা হবে।

গত পুর বোর্ডের প্রাক্তন মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত বলেন, ‘‘চিকিৎসকদের যে বেতন দেওয়া হয় তাতে চিকিৎসক মিলছিল না। তা ছাড়া ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ত। সদ্যোজাতদের রাখার অত্যাধুনিক সরঞ্জাম নেই। যে টাকা মেলে তাতে বিভিন্ন পরিষেবা চালাতে সমস্যা হচ্ছিল। অনেক গরিব পরিবারের মহিলারা মাতৃসদনের উপর নির্ভরশীল। এখানকার পরিষেবা উন্নত করা প্রয়োজন।’’মাতৃসদন থেকেই ওষুধ সরবরাহের কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে রোগীর আত্মীয়দের ওষুধ কিনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ। মাতৃসদনে ভর্তি প্রসূতিদের পরিবারের সদস্য মণি রাই, নাজদা খাতুনরা জানান, তাঁরা মাতৃসদনের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করেন। সে কারণে পুরসভার তরফে এখানকার চিকিৎসা পরিষেবার উন্নয়নে জোর দেওয়া দরকার। সমস্ত ওষুধ এখান থেকে পেলে ভাল হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন