এমনই হাল স্কুলবাসের। (বাঁ দিকে) দড়ি বেঁধে রাখা হয়েছে দরজা। (ডান দিকে) ভেঙে গিয়েছে পিছনের আলো। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
মদ্যপ চালক। খুলে যাওয়া যন্ত্রাংশ। আসন ভেদ করে বেরিয়ে আসা লোহার ধারালো অংশ। শিলিগুড়িতে স্কুলবাসে যাতায়াত দিন কে দিন বিপজ্জনক উঠছে পড়ুয়াদের পক্ষে। মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার দুই মদ্যপ চালককে নিয়ে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় অভিভাবকদের। এক জন বাসের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। তা সোজা গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে একটি পিকআপ ভ্যানকে। অন্য জন এতই খারাপ ভাবে বাস চালাচ্ছিলেন যে বাসযাত্রীদের আতঙ্কে দম বন্ধ হওয়ার দাখিল। শেষে ওই চালককে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন অভিভাবকেরা। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের এখন প্রশ্ন, আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলবাসে কতটা নিরাপদ? লড়ঝড়ে বাস যাও বা চলছিল, এখন চালকও যদি মদ্যপ হয় তা হলে তো যাত্রী পড়ুয়াদের প্রাণ সংশয়। স্কুলবাসে কী ধরনের সর্তকতা নিতে হবে, কোন কোন বিধিনিষেধ মানতে হবে, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা থাকলেও তা কার্যকর করার ব্যাপারে বাস মালিকদের কোনও তাপ উত্তাপ নেই। একই ভাবে প্রশাসনই বা কেন পদক্ষেপ করছে না, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকেরা। পরিবর্তে পুলিশ-প্রশাসনের তরফে আশ্বাস মিলেছে। কিন্তু কাজের বেলায় কয়েকটি বাসের নথিপত্র পরীক্ষা করা ছাড়া কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ। এই অবস্থায় অভিভাবকদের প্রশ্ন একটাই, আমাদের কী হবে? অবস্থাটা ঠিক কী, তা এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক।
আতঙ্কের দুই দিন
তির বেগে ছুটে যাওয়া স্কুলবাস গত মঙ্গলবার সকালে ধাক্কা মারে একটি পিকআপ ভ্যানকে। ঝাঁকুনিতে সিট থেকে পড়ে যায় পড়ুয়ারা। ভয়ে আতঙ্কে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় তাদের কয়েকজন। ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা বাসচালককে দুর্ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করতেই, পাল্টা হম্বিতম্বি শুরু করে সে। বাসিন্দাদের অভিযোগ চালক পুরোপুরি মদ্যপ অবস্থায় ছিল। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছিল না বলে তাঁদের দাবি। বাসিন্দাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিতে থাকে মদ্যপ চালক। পড়ুয়াদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার বাসের চালক মদ্যপ অবস্থায় রয়েছে জেনে প্রশাসনের নজরদারির নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাসিন্দারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। পুলিশ এসে চালককে গ্রেফতার করে। স্কুলবাসটি সেবক রোডের একটি স্কুলের। স্কুলের তরফে দাবি করা হয়, অসুস্থতার কারণে স্থায়ী চালক না আসায় এক অস্থায়ী চালককে বাস চালানোর ভার দেওয়া হয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অভিভাবকরা। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত বৃহস্পতিবার অভিভাবকরা আর একটি স্কুলবাসের মদ্যপ চালককে ধরে ফেলে। অভিভাবকদের অভিযোগ, বাসটির চাকা কখনও ফুটপাতে উঠে যাচ্ছিল, কখনও বা ফাঁকা রাস্তায় বারেবারে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। তাতেই সন্দেহ হওয়ায় কয়েকজন অভিভাবক চালককে টেনে নামিয়ে আনে। চালকের মুখদিয়ে মদের গন্ধ বের হচ্ছিল বলে দাবি। চালক মদ্যপানের কথা স্বীকারও করে। সেই সঙ্গে বাসের স্টিয়ারিং সহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ যথাযথ ভাবে কাজ করে না বলেও চালক দাবি করে। লাইসেন্সও দেখাতে পারেনি অভিযুক্ত চালক। এই ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে শিলিগুড়ি। রবীন্দ্রনগর মোড় সহ, কলেজ পাড়া, হাকিম পাড়ার বিভিন্ন এলাকায় বাসের অপেক্ষায় থাকা অভিভাবকরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। পরে ওই বাস সংস্থার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন অভিভাবকরা।
নির্দেশিকা এবং বাস্তব
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বাস চালকদের পড়তে হবে উর্দি ও জুতো। থাকতে হবে পরিচয়পত্র। যদিও, বুধবার শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া একটি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্তত দশটি বাসের কোনও চালকেই উর্দি পরে দেখা গেল না। কারও সঙ্গে পরিচয়পত্র নেই, কারও পায়ে হাওয়াই চটি, কারও পায়ে স্যান্ডেল। বিজয়কুমার থাপা নামে এক বাস চালক বললেন, ‘‘আমাদের উর্দি দেওয়া হয়নি। জুতো পরে বাস চালাতে হবে, এমন কথা তো জানি না।’’ প্রতিটি বাসে অবশ্যই ফার্স্ট এড বক্স এবং পানীয় জল সরবারহের ব্যবস্থা থাকার নির্দেশ রয়েছে। ফার্স্ট এড বক্স দেখা গেলেও, পানীয় জল সরবরাহের কোনও ব্যবস্থা দেখা যায়নি। বাসগুলির কোনওটাই স্কুলের নিজস্ব নয়। সবই বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থার। কোনও বাসেই সিসিটিভি ক্যামেরাও দেখা গেল না। এমনকী প্রতিটি বাসে অন্তত দু’টি আপদকালীন জানালা বা দরজা থাকার কথা থাকলেও, একটির বেশি জরুরি জানালা দেখা যায়নি কোনও বাসে। কয়েকটি বাসের পেছনের দিকে ‘ইমার্জেন্সি এক্সিট’ লেখা থাকলেও, অনেক কসরত করেও খোলা গেল না। জরুরি দরজার লকের চারদিকে মরচে জমে গিয়েছে।
দড়ি দিয়ে বাঁধা দরজা
বাসের হেডলাইটে লাল রঙের দড়ি জড়ানো। বাসের চালকের দাবি, হেডলাইট নড়বরে হয়ে গিয়েছে, দড়ি দিয়ে বাঁধা না থাকলে খুলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য স্কুলবাসের দরজায় স্বয়ংক্রিয় লক লাগানোর নির্দেশ রয়েছে, যদিও শহরে চলাচলকারী স্কুলবাসের দরজাও দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। ছিটকিনির হাতল নেই, তাই দড়ি দিয়ে বাঁধার ব্যবস্থা বলে বাস কর্মীদের দাবি। একটি বাসের সামনের চাকার ওপর লাগানো পাটাতনই খুলে গিয়েছে। যে কোনও সময়ে পাটাতন খুলে চাকার নীচে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। মাটিগাড়ার একটি স্কুলের সামনে দাঁড়ানো বড় স্কুল বাসের ভিতরের মেঝের লোহা উঠে গিয়েছে দেখা গেল। বাসের সিটের থেকে বিপজ্জনক ভাবে বেরিয়ে রয়েছে লোহার অংশ। ইঞ্জিন চালু হলেই বাসের ভিতর টিনের বাক্সের মতো কাঁপতে থাকে। চম্পাসারির একটি স্কুলের বাসে দেখা গেল ফার্স্ট এড বাক্সই নেই। বাসের জানলার লোহার হাতল তুবড়ে গিয়েছে। বাসের পেছন দিকের মার্টগার্ড খুলে নীচে ঝুলে গিয়েছে। চাকার গায়ে অসংখ্য ছোট গর্ত। এমনকী মেঝের একাংশের লোহার চাদরও উঠে গিয়েছে।
কী বলছে সুপ্রিম কোর্ট
দিল্লিতে একটি স্কুলবাসে দুর্ঘটনার পরে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট বিধি নিষেধে বেশ কিছু রদবদল করে। দেশের সব রাজ্যগুলিতে স্কুলবাসে যাতে সেই নির্দেশ কঠোর ভাবে মানা হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশ না মানলে ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৮৮ ধারায় মামলা রুজু করার নির্দেশ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী স্কুল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ এবং পরিবহণ দফতর সকলকে পড়ুয়াদের আনা-নেওয়ার বাস, পুলকারে নজরদারি চালাতে হবে। স্কুল বাস চালকদের নাম ঠিকানা পুলিশকে নথিভুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বাসগুলিকে প্রতিবছর কারিগরি পরীক্ষা করিয়ে ক্রুটি রয়েছে কিনা তা দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পরিবহণ দফতরকে।
‘সেটিং’ আছে, হুমকি
বেশ কিছুদিন আগের কথা। একটি স্কুল বাসের লড়ঝড়ে অবস্থা দেখে জেলা পরিবহণ দফতরের এক আধিকারিককে অভিযোগ জানিয়েছিলেন কয়েকজন অভিভাবক। তারপরেও কোনও পদক্ষেপ না হওয়ায়, পদস্থ এক আধিকারিকের কাছে অভিযোগ পাঠানো হয় বলে দাবি। অভিযোগের জের উল্টে তাঁদেরই ভুগতে হবে তা অবশ্য বুঝতে পারেননি অভিভাবকরা। পরিবহণ দফতর থেকে পদক্ষেপ দূরের কথা উল্টে কেন অভিযোগ করা হয়েছে তা নিয়ে অভিভাবকদেরই বাস মালিকের হম্বিতম্বির মুখে পড়তে হয়। ফের অভিযোগ করলে তাদের ছেলে-মেয়েদের বাসে তোলা হবে না বলে হুমকিও দেওয়া হয়। এক অভিভাবকের কথায়, ‘‘আমাদের এক বাসকর্মী বলেছিলেন, কোথায় গিয়ে কিছু হবে না, সব নাকি সেটিং আছে।’’ এই ‘সেটিং’ অথবা বন্দোবস্তর জেরেই পুলিশ-প্রশাসন বা কোন মহল থেকেই স্কুলবাস আইন মেনে চলছে কিনা তার কোনও পদক্ষেপ হয় না বলে অভিযোগ।
কী বলছে প্রশাসন
ভাঙা বাসে পড়ুয়াদের বিপদ মাথায় করে যাতায়াত করতে হচ্ছে রোজ। তবুও হুঁশ নেই পুলিশ-প্রশাসনের। স্কুলবাস মালিকদের সংগঠনের আশ্বাসে তাই ভরসা করতে চান না অভিভাবকরা। বাস মালিক সংগঠনের সম্রাদক শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বেশ কিছু বাসের পরিকাঠামো বদলানো হয়েছে। পুরোনো বাসগুলিও বদলে ফেলা হচ্ছে। এর জন্য কিছু সময় প্রয়োজন। তবে পড়ুয়াদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার নিয়ে যাতে এতটুকু ক্রুটি না থাকে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।’’ শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বার্মা বলেন, ‘‘স্কুলবাসের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আমরা বিশেষ ভাবে নজর রাখছি।’’ গত মঙ্গলবারের দুর্ঘটনার পরে স্কুলবাস নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছেন দার্জিলিঙের জেলাশাসক।