নিত্যগোপালবাবুর স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন পরিজনেরা। ছবিটি তুলেছেন রাজকুমার মোদক।
গোটা সংসার যার কাঁধে ছিল, তিনি নেই। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা কী ভাবে চলবে বুঝে উঠতে পারছেন না নিত্যগোপাল বর্মনের স্ত্রী দিনবালা দেবী। তার চেয়েও বড় চিন্তা হয়ে দাড়িয়েছে সংসার চলবে কী ভাবে? মুলি বাঁশের বেড়া ও টিনের চালা দেওয়া চারটি ঘরে এখন সে প্রশ্নই উঠছে বারবার। শুক্রবার ধূপগুড়ির বানারহাট থানা এলাকার ফটকটারি গ্রামে নিত্যগোপালবাবুর দেহ পাওয়া যায়।
বাবা, দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে নিত্যগোপালবাবু ফি বছর আলু ও ধান চাষ করে কোনও ভাবে সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন। বাড়তি আয়ের সুযোগ আগে বছর তিনেক আগে মোটা অঙ্কের কমিশনের টোপে পড়ে এক অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট হন তিনি। তবে তা বেশি দিন চলেনি। সারদা কাণ্ডের পর সে সংস্থাটিও পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলে বিপাকে পড়েন। ওই কৃষক গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা তুলেছিলেন। গত বছর আলু ফলিয়ে যা লাভ করেছেন, তার বেশির ভাগ টাকা চলে যায় আমানতকারিদের টাকা ফেরত দিতে।
তবুও ঋণ শোধ হয়নি। বাড়ির লোকজন জানান, আরও দেড় লক্ষ টাকা আমানতকারীরা পাবেন। সে জন্য মাঝে মধ্যে লোকজন নিত্যগোপালবাবুর বাড়িতে হানা দিতেন। সব টাকা তিনি আলু চাষ করে ফেরত দেবেন বলে জানিয়ে দেন আমানতকারিদের। তবে ঋণের দুষ্ট চক্রের ফাঁদে পড়ে তিনি যে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন, তা ভাবেননি কেউই।
গতবার বাবার পাঁচ বিঘে জমির পাশাপাশি জলঢাকা নদীর পাশে অন্যের আরও দশ বিঘে জমি লিজে নিয়ে আলু ফলান তিনি। সে জন্য ৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা খরচও হয়। যার বেশির ভাগ টাকা তিনি তিনটি ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তবে ফলন ভাল হলেও আলুর বাজার দর ক্রমশ কমে আসতে শুরু করায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন ওই চাষি।
আমানতকারিদের টাকা ফেরত তো দূরে থাক, ব্যাঙ্কের ঋণ কী ভাবে শোধ করবেন, তা নিয়ে বেজায় দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েন ফটকটারি গ্রামের ওই চাষি। তাঁর পরিবারের দাবি, তাতেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হন তিনি। বর্ধমানের পরে এ বছর উত্তরবঙ্গের মধ্যে তিনি প্রথম আত্মঘাতী কৃষক।
কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়ের কথায়, “কৃষি জনিত কারণে কোন চাষি আত্মঘাতী হননি। এ ক্ষেত্রে জেলাশাসক তদন্ত করে রিপোর্ট দেবেন। তবে যে ভাবে আলু নিয়ে বামেরা অবরোধ করছে তা মানা যায় না।” তাঁর অভিযোগ, “বাম আমলে অনেকবার কৃষক আলুর দাম পাননি। সে সময় তারা চোখ বুজে ছিলেন। আমরা তো কৃষকের পাশে রয়েছি।”
কৃষি বিপণন মন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে সিপিএম-এর জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য বলেছেন, “বাম সরকার কী করেছে আর কী করেনি, তা তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাবে। সেটা আলু চাষি ও সাধারণ মানুষজন জানেন। এখন তৃণমূল দায় এড়ানোর চেষ্টা করলে হবে না।”
কৃষকের মৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার ধূপগুড়িতে পৌঁছে ওই চাষির বাড়িতে যাবেন রাজ্যের বিরোধী দল নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এদিন ধূপগুড়ির সিপিএম বিধায়ক মমতা রায় একথা জানিয়ে অভিযোগ করেন, সরকারের উদাসীনতায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
তবে নিত্যগোপালবাবুর মৃত্যুর কারণ জানতে পুলিশের পাশাপাশি কৃষি দফতর থেকেও পৃথকভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে
স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য শরত্চন্দ্র সাহা বলেন, “ছেলেটি একটি অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট ছিল। ওই সংস্থার হয়ে কয়েক লক্ষ টাকা তুলেছে। সংস্থাটি উঠে যাওয়ার পর থেকে টাকা কেমন করে ফেরত দেবে সেই দুশ্চিন্তায় ভুগছিল।”
এদিন বিকেল নাগাদ মৃত চাষির দেহ গ্রামে পৌঁছলে সেখানে যান ব্লক তৃণমূল নেতৃত্ব। এদিকে চাষির মৃত্যুর কারণ জানতে দিনভর ঘটনার খোঁজ নেন কৃষি দফতরের কর্তারা। ধূপগুড়ি ব্লক কৃষি আধিকারিক দেবাশিস সর্দার বলেন, “কেন ওই চাষি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “মর্মান্তিক ঘটনা। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওই চাষি সামান্য পরিমাণ জমিতে আলু চাষ করেছেন। কিন্তু একটি অর্থ লগ্নি সংস্থার এজেন্ট ছিলেন সংস্থাটি উঠে গিয়েছে। আমানতকারিদের চাপ ছিল।”