জালে আজ ওঠে ভাসানের কাঠ

দিনের শেষে বাড়ি ফেরার পথে আফসোস ইউনুসের, ‘‘তিন বছর আগেও এই নদীতে জাল ফেললে বোয়াল, গলদা চিংড়ি, কাতল বা রুই উঠত। এখন কিছুই মেলে না।’’

Advertisement

গৌর আচার্য

রায়গঞ্জ শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৯ ০২:১৮
Share:

বদ্ধ: রায়গঞ্জের খরমুজাঘাট এলাকায় কুলিক। ছবি: চিরঞ্জীব দাস

রায়গঞ্জের বাহিন গ্রাম পঞ্চায়েতের সুভাষগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ইউনুস আলি। দিনমজুরির কাজ করেন। রবিবার দুপুরে কুলিকের জলে জাল ফেলেছেন তিনি। কুলিক পক্ষিনিবাসের পাশে তাঁর একাগ্র চেষ্টায় উঠতে লাগল কখনও প্রতিমার কাঠের টুকরো, কখনও প্লাস্টিক বা সিমেন্টের ফেলে দেওয়া বস্তা। সঙ্গে অবশ্য ফাউ হিসেবে কিছু পুঁটি আর চিংড়িও পেলেন তিনি।

Advertisement

দিনের শেষে বাড়ি ফেরার পথে আফসোস ইউনুসের, ‘‘তিন বছর আগেও এই নদীতে জাল ফেললে বোয়াল, গলদা চিংড়ি, কাতল বা রুই উঠত। এখন কিছুই মেলে না।’’

রায়গঞ্জের কুলিক পক্ষিনিবাসের পরিযায়ী পাখিদের খাবারের সংগ্রহের প্রধান ভরসা এই কুলিক নদী। প্রতি বছর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পক্ষিনিবাসে ওপেন বিলস্টক, নাইট হেরন, করমোর‌্যান্ট, ইগ্রেট-সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আসে। পরিযায়ীরা কুলিক নদীর মাছ, জলজ পোকা ও শ্যাওলা খেয়ে বেঁচে থাকে। পরিবেশ ও পশুপ্রেমী সংগঠনগুলির অভিযোগ, প্রশাসন ও বন দফতরের নজরদারির অভাবে দীর্ঘদিন ধরে বাসিন্দাদের একাংশ কুলিক নদীতে আবর্জনা ফেলছেন। দিনভর বিভিন্ন পণ্যবাহী গাড়ি নদীতে নামিয়ে ধোয়া হয়। এই দূষণেই নদীতে মাছ, জলজ পোকা ও শ্যাওলার অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বসেছে। পাশাপাশি, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নদী সংস্কার ও পলি তোলার কাজ হয়নি। তাই নদীর নাব্যতা কমে গিয়েছে। ফলে বর্তমানে গরমের শুখা মরসুমে নদীর বিভিন্ন অংশে জল শুকিয়ে চর পড়েছে। অনেক জায়গায় বাসিন্দারা হেঁটেই নদী পারাপার করতে পারেন। তাঁদের কথায়, প্রশাসন ও বন দফতর নদী দূষণ রুখে নদীর নাব্যতা বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগী না হলে, ভবিষ্যতে খাবারের সঙ্কটে পড়বে পাখিরাও।

Advertisement

উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি কবিতা বর্মণ ও রায়গঞ্জের বিভাগীয় বনাধিকারিক দ্বিপর্ণ দত্তের দাবি, অতীতে জেলা পরিষদ ও বন দফতরের তরফে নদী দূষণ রুখতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এ বারে ধারাবাহিক কর্মসূচি শুরু করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। প্রশাসনের দাবি, কয়েকবছর আগে ১০০ দিনের প্রকল্পে নদীর বিভিন্ন অংশের নাব্যতা বাড়ানোর কাজ হয়েছে। তা সত্ত্বেও কোথাও নদীপথ বাধাপ্রাপ্ত বা অগভীর হয়ে থাকলে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।

রায়গঞ্জের কমলাবাড়ি-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের আব্দুলঘাটা এলাকার বাসিন্দা বাবলু বর্মণ ও বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েতের বিন্দোল সদর এলাকার বাসিন্দা মনসুর আলির দাবি, ‘‘এক দশক আগেও আমরা শুখা মরসুমে পাম্প মেশিনের সাহায্যে নদী থেকে জল তুলে পাশের জমিতে সেচের কাজে লাগাতাম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে গরমে নদীতে আর জল থাকে না। একসময়ে রায়গঞ্জ, হেমতাবাদ ও ইটাহারের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা নদী থেকে মাছ তুলে তা বাজারে বেচে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু দূষণ ও জলের অভাবে এখন আর নদীতে মাছ মেলে না।’’

কুলিক নদীটি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে শুরু হয়ে হেমতাবাদ, রায়গঞ্জ ও ইটাহারের বিভিন্ন এলাকা হয়ে নাগর নদীতে মিশেছে। জেলায় ওই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৬ কিলোমিটার।

রায়গঞ্জের এক পরিবেশপ্রেমী দাবি করেন, গরমের মরসুমে সেচের জলের জোগান স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলায় রাবারের বোল্ডার ফেলে কুলিকের পথ আটকে দেওয়া হয়। তার জেরে উত্তর দিনাজপুরে ৬৬ কিলোমিটার নদীর বিভিন্ন অংশ শুকিয়ে চড়া পড়ে যায়। এ ভাবে গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হতে থাকলে একদিন হয়তো নদীটি হারিয়েই যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন