ক্লাস: বয়স্কদের শৌচালয়ের গুরুত্ব বোঝাচ্ছেন পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র
জামাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যন্ত ত্যাগ করতে রাজি লালু হোড়। সকালবেলা মাঠেই শৌচকর্ম ত্যাগ করতে পারেন না।
জামাই নিমাই টিগ্গাও নাছোড়। তাঁরই সহায়তায় এলাকার খুদে পড়ুয়ারা রোজ লালুর বাড়ির সামনে নজরদারি শুরু করেছে। মাঠে যাওয়া আটকে দিয়েছে। লালুবাবু ক্ষেপে লাল। মেয়েকে ডেকে ক্ষুব্ধ লালু জামাইয়ের সঙ্গে সব রকম ‘সম্পর্ক ছেদ’ করবেন বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু দমেনি পড়ুয়ার দল।
চেঁচাই প্রাথমিক স্কুলে টাইল্স মার্বেল পাথরে তৈরি শৌচালয়ে অভ্যস্ত চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া রিতু বান্ডোর কথাই ধরা যাক। বাবা রবীন্দ্রনাথ বান্ডো এলাকার উপপ্রধান হলেও মাঠঘাটেই শৌচকর্মে অভ্যস্ত। রিতু জেদ ধরে বসে, বাড়িতে শৌচালয় না বানালে সে স্কুলেই যাবে না। চতুর্থ শ্রেণির নয়ন বর্মন আবার বাবা মাকে বলে কাজ না হওয়ায় শৌচকর্মে ব্যবহারের ‘পাত্র’ লুকিয়ে রাখতে শুরু করে। মা পুষ্পদেবীর কথায়, ভোরবেলা মাঠে যেতে গিয়ে পাত্র খুঁজে না পেয়ে বাড়িতে হইচই পড়ে যায়।
পড়ুয়াদের লাগাতার আবদারের জেরে এলাকার অভিভাবক তথা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী দয়ামনি বর্মন থেকে সুদীপাদেবী, পুষ্পদেবীরা দল বেঁধে ওই স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছে গিয়ে দরবার করে বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েরা অনবরত শৌচালয়ের জন্য জেদ ধরে আছে। কিন্তু বাড়িতে পাকা শৌচালয় তৈরির আর্থিক সামর্থ্য আমাদের নেই। আপনারাই কিছু করুন।’’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক পবিত্র মোহান্ত বলেন, নির্মল বাংলা অভিযান তখন শুরু হয়নি। এলাকার গরিব দিনমজুর ও কৃষিজীবী পরিবারের পক্ষে পাকা শৌচালয় তৈরির মতো আর্থিক ক্ষমতা সত্যিই ছিল না। এরপর স্কুলের তরফে জেলাপরিষদের দ্বারস্থ হলে ৪ হাজার ৮০০ টাকার প্রকল্পে ৩ হাজার ৯০০ টাকা ভর্তুকিতে পাকা শৌচালয় তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। তবে উপভোক্তাকে প্রকল্পের অংশ হিসাবে ৯০০ টাকা জমা দিতে হবে। কিন্তু অনেকের সেই টাকা দেওয়ারও সামর্থ্য ছিল না। তাই দেখে চিন্তায় পড়ে যান স্কুল শিক্ষকরা। অবশেষে সহৃদয় কয়েকজন ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় গ্রামের ৭২টি পরিবারের বাড়িতেই পাকা শৌচালয় তৈরি হয়ে যায়। লালুবাবু, রবীন্দ্রনাথবাবু, দয়ামনিদেবীরা এখন মাঠঘাট নয়—বাড়িতে পাকা শৌচালয় ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
খুদে পড়ুয়াদের মাধ্যমে ও শিক্ষকদের উদ্যোগের ফলে গত ২০১২ সালে চেঁচাই প্রাথমিক স্কুলটি এ রাজ্যের ‘প্রথম নির্মল গ্রামে’র শিরোপা পেয়েছিল। সম্প্রতি কেন্দ্রের বিচারে ভারতের ‘দ্বিতীয় স্বচ্ছ বিদ্যালয়ে’ ভূষিত হয়ে চেঁচাই প্রাথমিক স্কুলটি পুরস্কার পেয়েছে। পাশের পাহাড়পুর, ভবানীপুর ও নোনাপাড়া এলাকায় গিয়ে পথনাটকের মাধ্যমে সেখানকার খুদে পড়ুয়া ও বাসিন্দাদের তারা সচেতনতার প্রচার করছে। ওই তিনটি গ্রামের প্রায় ৪০০টি পরিবারের সকলে বাড়িতে পাকা শৌচালয় তৈরি করে ব্যবহার করবেন, এই আশা নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতার কথা সকলকে শোনাচ্ছে চেঁচাইয়ের চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া রচনা, দেব, মানিক, গীতা, তনিমারা।