নিজের বাড়িতে সিদ্দিকা পারভিন। — নিজস্ব চিত্র
বছর তিনেক আগে তাঁর চিকিৎসা নিয়ে শাসক এবং বিরোধী দলের আগ্রহ ও সহায়তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। শেষে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্রের উদ্যোগে দিল্লির এইমসে অপারেশনের পর মরণাপন্ন অবস্থা থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন তিনি। তারপর টাঙন নদী দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বংশীহারি ব্লকের শ্রীরামপুর গ্রামের সেই অতিকায় তরুণী সিদ্দিকা পারভিনের জীবন সংগ্রামে এখন আর কেউ সামিল নেই। আত্মীয়দের অভিযোগ, ব্লক থেকে রেশনের চাল ছাড়া আর কোনও সহায়তা মেলেনি। বংশীহারির বিডিও অতুলকৃষ্ণ অধিকারী বলেন, ‘‘সিদ্দিকার জন্য প্রতি মাসে বাড়তি চালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওর চিকিৎসায় আর্থিকভাবে সাহায্যের জন্য সমাজকল্যাণ দফতর সহ কয়েকটি বিভাগে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সেগুলি কোন স্তরে রয়েছে খোঁজ নেব।’’
পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমারের সমস্যায় ২৩ বছর বয়স থেকে সিদ্দিকার চেহারা দীর্ঘ হতে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তার খাবারের চাহিদা। রোজ তার প্রায় দু’কেজি চালের ভাত খাওয়ার চাহিদা মেটাতে হিমসিম খেতে হয় গরিব পরিবারটিকে। ৮ ফুট উচ্চতার তরুণী সিদ্দিকা এরপর ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সোজা হয়ে হাঁটাচলাও বন্ধ হয়ে যায়। এখন সিদ্দিকার বয়স ৩০ বছর। ২০১৩ সালে দিল্লির এইমসে অস্ত্রোপচার এবং পরবর্তীতে প্রতি মাসে কলকাতার এসএসকেএমে গিয়ে একটি করে ইঞ্জেকশন নিয়ে সিদ্দিকার দেহের বৃদ্ধি ৮ ফুটের চেয়ে আর বাড়েনি। তবে এখনও পুরো সুস্থ নন। সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। হুইলচেয়ারই তার সম্বল।
দিন মজুর বাবা আফাজুদ্দিন সিদ্দিকার চিকিৎসা চালিয়ে যেতে দু’দফায় ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ করেছেন। এখন কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ ও মেয়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমসিম খাচ্ছেন। তিনিই জানালেন, কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে গিয়ে প্রতি মাসে সিদ্দিকা পারভিনকে বিনামূল্যে একটি করে ইঞ্জেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই করে দিয়েছেন। কিন্তু গত প্রায় এক বছর ধরে বংশীহারির অজ পাড়াগাঁ শ্রীরামপুর থেকে প্রতি মাসে কলকাতায় যাতায়াতের ট্রেন ও গাড়ি ভাড়া এবং থাকা খাওয়ার খরচ জোগার আর হয়ে উঠছে না। তার উপর প্রয়োজন মাফিক খাবার না পেয়ে পুষ্টির অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে ওই তরুণী।
সিদ্দিকার বাবা আফাজুদ্দিনের কথায়, ‘‘মেয়েকে প্রতি মাসে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের বহির্বিভাগে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় দু’টি ব্যাঙ্ক থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ঋণ নিতে হয়েছে। প্রতি মাসে ওই দু’টি ঋণের ১,৪৪০ টাকা করে কিস্তি পরিশোধ করতে মজুরিতে রোজগারের প্রায় সব টাকাই খরচ হয়ে যাচ্ছে। অথচ ওই ইঞ্জেকশন না দিলে ওর সামান্য চলাফেরার ক্ষমতাটুকুও নষ্ট হয়ে যাবে।’’ দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে দিনমজুর আফাজুদ্দিনের সংসারে নিত্য অভাব। বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারটিকে ডিজিটাল কার্ড করে মাসে মাথাপিছু পাঁচ কেজি করে চালের ব্যবস্থা ব্লক প্রশাসন থেকে করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতি মাসে ওই চাল ঠিকমতো মেলে না বলে পরিবারটির অভিযোগ।
বংশীহারির বাসিন্দা তথা জেলা তৃণমূল নেতা অখিল বর্মন বলেন, ‘‘সিদ্দিকার বর্তমান পরিস্থিতি এবং সমস্যার বিষয়টি কেউ জানাননি। খোঁজ নিয়ে ওকে সহযোগিতা করা হবে।’’ ২০১৩ সালে লোকসভা ভোটের আগে অসুস্থ সিদ্দিকার পাশে দাঁড়িয়েছিল জেলা কংগ্রেস। সে সময়ই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বালুরঘাটের তৃণমূল নেতৃত্ব সিদ্দিকাকে তড়িঘড়ি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে এসএসকেএমে ভর্তি করে দেন। দীর্ঘ প্রায় দেড় মাস সেখানে ভর্তি থেকেও সিদ্দিকার অপারেশন শেষপর্যন্ত হয়নি। কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর শয্যাশায়ী মরণাপন্ন সিদ্দিকাকে ২০১৩ সালের ১০ নভেম্বর জেলা কংগ্রেসের উদ্যোগে দিল্লির এইমস হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানো হয়। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্রের উদ্যোগে সিদ্দিকার পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার অপরেশন সফল হয়। অনেকটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।
কিন্তু তারপর থেকেই অর্থাভাবে তার ধারাবাহিক চিকিৎসা ব্যাহত হয়। ওমপ্রকাশবাবু বলেন, ‘‘তখন সিদ্দিকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল বলে আমরা সাহায্যে এগিয়ে গিয়েছিলাম। এখন সিদ্দিকার পরিবারের তরফে আমাকে কিছু জানায়নি, খোঁজ নেব। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি সাহায্যে এগিয়ে এলে ভাল হয়।’’ এ দিন জেলা কংগ্রেস সভাপতি নীলাঞ্জন রায় বলেন, ‘‘আমরা খোঁজ নিচ্ছি। সিদ্দিকার জন্য কতটা কী করা যায় দেখব।’’
সিদ্দিকার মা মনসুরা বিবি জানান, তাঁরা কলকাতায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও দেখা হয়নি। তবে তাঁর নির্দেশে প্রতি মাসে মেয়েকে বিনামূল্যে একটি করে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সুবিধা মিলেছে। কিন্তু কলকাতা পর্যন্ত প্রতি মাসে যাবেন কী ভাবে, সেই ভাবনাতেই দিশাহীন গোটা পরিবার।