দু’বার করে বিক্রি নদীখাতের রিসর্টে

শুধু চর দখল করে চাষাবাদ বা ছোট বাড়ি তৈরিই নয়, উত্তরবঙ্গে ক্রমে মরে যাওয়া নদীখাতে কোথাও হচ্ছে বহুতল। কোথাও রিসর্ট। সেই রিসর্ট ও তার সংলগ্ন জমি আবার বেচা হচ্ছে একাধিকবার। এর ফলে যেমন ধাক্কা খাচ্ছে পরিবেশ, তেমনই তৈরি হচ্ছে বন্যার আশঙ্কাও। এলাকা ঘুরে দেখে আনন্দবাজারের নিজস্ব প্রতিবেদন।শিলিগুড়ি শহরের মধ্যে মহানন্দা নদীখাতের মধ্যেই পাকা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার কোনওটা একতলা, কোনওটা দোতলা, তিনতলাও। নদীখাতের মধ্যে কী করে প্রকাশ্যে এ ভাবে নির্মাণ কাজ চলছে, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিবেশপ্রেমী তথা সচেতন বাসিন্দাদের অনেকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩৪
Share:

নদীর খাতে এভাবেই গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

মহানন্দায় বহুতল

Advertisement

শিলিগুড়ি শহরের মধ্যে মহানন্দা নদীখাতের মধ্যেই পাকা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার কোনওটা একতলা, কোনওটা দোতলা, তিনতলাও। নদীখাতের মধ্যে কী করে প্রকাশ্যে এ ভাবে নির্মাণ কাজ চলছে, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিবেশপ্রেমী তথা সচেতন বাসিন্দাদের অনেকে। পুরসভার তরফেও ওই সমস্ত অবৈধ নির্মাণ বন্ধ করতে নোটিস দেওয়া হয়েছে। তার পরেও অবস্থা বদলায়নি। নদীর জায়গায় নির্মাণ কাজ চলছে অবাধে। পরিবেশপ্রেমীদের অনেকেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পুর কর্তৃপক্ষের একাংশ মনে করছেন, অন্তত একশো বাড়ি এই ভাবে গড়ে উঠছে মহানন্দা নদীখাতে। এক, দুই, তিন নম্বর ওয়ার্ডে নদীর ধার ঘেঁষে। অভিযোগ, এর পিছনে নেতাদের একাংশ সক্রিয়। পাকা বাড়ি তুলতে বা বাড়ির তল বাড়াতে টাকা দিতে হয় তাঁদের। কেউ কোনও আপত্তি তুললে দর দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ বেড়ে যায়।

পুরসভার ডেপুটি মেয়র রামভজন মাহাতো জানান, অবৈধ ভাবেই ওই সমস্ত বাড়ি তৈরি হচ্ছে। পুরসভার তরফে একাধিকবার নোটিস পাঠানো হয়েছে বেআইনি ভবন তৈরি না করতে তবে কাজ হয়নি। নদীখাত থেকে অবৈধ নির্মাণ বন্ধ করাও যে শক্ত কাজ, তা বোঝেন বর্তমান পুর কর্তৃপক্ষও। সম্প্রতি বোর্ড মিটিংয়ে নদীখাতের মধ্যে থাকা ওই সমস্ত অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন মেয়র পারিষদদের একাংশ। কেন না সব দল এক না হলে ওই অবৈধ নির্মাণ যে বন্ধ করা কঠিন তা বোঝেন সকলেই। নির্মাণের ক্ষেত্রেও স্থানীয় নেতাদের টাকা-পয়সা দিতে হয় বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। পরিবেশ প্রেমী সংস্থা হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, ‘‘নদীখাতের মধ্যে এ ধরনের অবৈধ নির্মাণ বন্ধ করতে দলমত নির্বিশেষে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।’’ তাঁদের দাবি, কলাইবাড়ি থেকে ফুলবাড়ি পর্যন্ত মহানন্দা নদীখাত দখল করে অন্তত ৫০ হাজার লোক বসবাস করছে। তাদেরই একাংশ এখন নদীর মধ্যে পাকা নির্মাণও করছেন। পুর কমিশনার সোনম ওয়াংদি ভুটিয়া বলেন, ‘‘বিষয়টি সেচ দফতরকে জানিয়ে তাদের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে।’’

Advertisement

ডুয়ার্সে নদীতে রিসর্ট

গত কয়েক বছর ধরেই মালবাজার শহরে জমির দাম বেড়েই চলেছে। শহরে ফাঁকা জমিও আর খুব একটা নেই বলে জমির কারবারিরা দাবি করেন। তবে আশেপাশে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের জন্য এলাকায় জমির চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে। তাই বিকল্প খুঁজে বের করেছেন জমির কারবারিরা। শহর লাগোয়া নেওড়া নদীর চরে খুঁটি পুঁতে জমি বিক্রি করতে শুরু হয়। বছর তিনেক আগে এ নিয়ে বাসিন্দাদের একাংশ প্রশাসনে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তার পরেও কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি বলে অভিযোগ। কাঠা পিছু দেড় থেকে দু’লক্ষ টাকা দরে জমি বিক্রি চলতে থাকে। প্রায় ৫০ বিঘা জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। এক সময়ের দাপুটে বাম নেতা গত বিধানসভা ভোটের পরে তৃণমূলে যোগ দেন। বাসিন্দাদের দাবি, তিনি নেওড়া নদীর চরের জমি কেনাবেচার বিষয়টি ‘দেখভাল’ করেন। তবে এখনও পর্যন্ত চরে কোনও কাঠামো তৈরির কাজ হয়নি। শুধুমাত্র খুঁটি দিয়ে জমি চিহ্নিত করে রাখতেই দেড় কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। মূর্তি নদীতে রিসর্টের জন্যও চরের জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। বেশ কয়েকটি বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থা নামে বেনামে চরের জমি দখল করেছিল বলে অভিযোগ। তার জন্য স্থানীয় জমির কারবারিরা সেই সব সংস্থা থেকে কোটি কোটি টাকা আদায় করেছিল বলে অভিযোগ। বর্তমানে সেই সব অর্থলগ্নি সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা হয় জেলবন্দি, নয়তো বা বেপাত্তা। সেই সুযোগে মূর্তির দখল করে রাখা জমি ফের হাতবদল হতে শুরু হয়েছে। যে চরের জমি কাঠাপিছু দেড় লক্ষ টাকায় বছর চারেক আগে বিক্রি হয়েছিল, সেই জমি ফের দু’ থেকে আড়াই লক্ষ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্তত দেড়শ বিঘা জমি দখল করে দু’বার বিক্রি হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। এক জমি দু’বার বিক্রি করে ফুলে ফেঁপে উঠছেন জমির কারবারিরা। লেনদেনের বহর ছুঁয়েছে কোটি টাকার অঙ্ক।

তবে মালবাজার ব্লকের ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক সুশান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘নদীর চরে কোথাও নির্মাণ শুরু হয়নি। তবে লেনদেন এবং দখলে যে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

বন্যার আশঙ্কা, আশ্বাস

চর দখল করে নির্মাণ হলে বেড়ে যায় বন্যার আশঙ্কা। নদী ছোট হোক বা বড় জল প্রবাহ বাধা পেলে, উল্টো দিকে ঘুরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করবে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম বলে জানিয়েছেন সেচ দফতরের কর্তারা। বছরের পর বছর ধরে গতি প্রবাহিত বাঁধা পেলে ছোট নদীর শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। নদীখাতের দখলদার উচ্ছেদ বা দেখভালের দায়িত্ব ছিল এতদিন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের। রাজ্য সরকারের নির্দেশে এখন তা দেখে সেচ দফতর। উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারপার্সন মানস ভারতী বলেন, ‘‘নদীখাত দখলের সমস্যা যথেষ্ট গভীরে। এ নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক হবে। সে বৈঠকে বিস্তারিত পরিস্থিতি জেনে সংশ্লিষ্ট বিভাগের আধিকারিকদের পুলিশে অভিযোগ করার নির্দেশ দেওয়া হবে।’’

কবে সেই পদক্ষেপ হয়, এখন তারই অপেক্ষা। (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন