খুশি একলব্য স্কুলের ছাত্রেরা। ছবি: সব্যসাচী ঘোষ
তপসিলি উপজাতিদের জন্যেই স্কুল। প্রায় সকলেই চা শ্রমিক পরিবারের থেকে আসা পড়ুয়া। ৭০ শতাংশ পড়ুয়া আবার পরিবারের মধ্যে প্রথম শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু পিছিয়ে থেকে শুরু করেও এখন ওরাই সেরার সেরা।
ডুয়ার্সের একলব্য মডেল আবাসিক বিদ্যালয়ে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকের ফল নজরকাড়া। নজিরবিহীন ভাবে এই স্কুলের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা ৪৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে সকলেই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে। তিন জন পেয়েছে স্টার মার্কস। ওঁরাও, টোপ্পো, রাভা উপজাতিভুক্ত পড়ুয়ারা এত ভাল ফল করে দেখাতে পারে, তা শুনেই চোখ কপালে উঠে গেছে শহরের বড় বড় স্কুলগুলোর। বিস্তীর্ণ চা বাগানের পিছিয়ে পড়া এলাকার পড়ুয়াদের ক্রমাগত খারাপ ফলের জন্যেই যেখানে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে পাশের শতাংশের হারে রাজ্যের সব থেকে নীচে থাকে জলপাইগুড়ি জেলা, সেখানে সেই চা বাগানের ছেলে মেয়েরাই যে ভাল শিক্ষার সুযোগ পেলে বদলে যেতে পারে। তাই যেন প্রমাণ করে দিল একলব্য মডেল আবাসিক স্কুল।
সোমবার ফল জানার পর মঙ্গলবার উচ্চ মাধ্যমিকের কৃতীরা স্কুলে মার্কশিট আনতে এসেছিল। ওরা আসতেই কার্যত উৎসবের মেজাজ তৈরি হয় একলব্যতে। শিক্ষকদের সঙ্গে ছবি তুলে মিষ্টিমুখ করানো হয় সকলকে। অকাল হোলিও খেলা হয়ে যায় স্কুলে। উচ্ছ্বসিত দু’জন অভিভাবকও মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়ে যান স্কুলে।
একলব্য স্কুলটি ইংরেজি মাধ্যমের। এখানে শুধুমাত্র কলাবিভাগেই উচ্চমাধ্যমিক পড়ানো হয়। স্কুলের মধ্যে এ বার উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হয়েছে ভূটান সীমান্ত ঘেসা জিতি চা বাগানের রাজ ওঁরাও। রাজ পেয়েছে ৩৯৪। রাজের বাবা টিংকু ওঁরাও জিতি চা বাগানের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক। মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে শিলিগুড়ি লাগোয়া খাপরাইলের বাসিন্দা প্রীতি লাকড়া। প্রীতির বাবা জুনাস লাকড়া উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রমিক হিসাবে কর্মরত। চামূর্চি চা বাগানের পড়ুয়া সুজিত ওঁরাও ও স্টার নম্বর পেয়েছে। চা শ্রমিকের ছেলে সুজিতের প্রাপ্ত মোট নম্বর ৩৭৮।
এ দিন স্কুলের অধ্যক্ষ, শিক্ষকদের জন্যে মিষ্টি নিয়ে চলে আসেন শুল্কাপাড়ার বাসিন্দা রাজেন কুজুর। রাজেনবাবু বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকে ছেলে রোহিত প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হবে, তার কোনও আশা ছিল না। পুরো কৃতিত্বই স্কুলের। একলব্যের অধ্যক্ষ অমরজিত সিংহ চহ্বাণ বলেন, ‘‘গত ২০০৫-এ স্কুলের প্রথম ব্যাচ উচ্চ মাধ্যমিকের পড়া শুরু করে। ২০০৭ থেকে স্কুলের পড়ুয়ারা উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষায় বসতে শুরু করে। তখন থেকেই ভাল ফলের জন্যে শিক্ষকেরা খেটে চলেছেন। একটু একটু করে মানও বাড়ছিল।’’ গত বছর মোট পরীক্ষার্থীর ৮০ শতাংশ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল। এ বার তা একশো শতাংশ হয়ে যাওয়ায় লক্ষ্যপূরণ হয়েছে।
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর স্কুলের অধ্যক্ষ অমরজিত সিংহ চহ্বাণ যে ভাবে শৃঙ্খলা আর নিয়মানুবর্তিতার পরিবেশ স্কুলে বজায় রেখেছেন, তাতেই এই সাফল্য মিলেছে বলে মত অনেকেরই। কিন্তু গত দু’বছর আগে কড়া ধাঁচের এই অধ্যক্ষের অপসারণ চেয়েই অভিভাবকদের একটা বড় অংশ স্কুল বন্ধ করে আন্দোলনও শুরু করে দিয়েছিলেন। পুলিশ প্রশাসনকেও সে সময় স্কুল খোলাতে উদ্যোগী হতে হয়, সেই অমরজিতবাবুর নেতৃত্বেই এই রকমের ফল যাবতীয় সমালোচনার যোগ্য জবাব বলেই মনে করছেন অনেকে। স্কুলের এই ফলে খুশি জলপাইগুড়ির জেলাশাসক পৃথা সরকারও। পৃথা বলেন, ‘‘ওদের জন্যে আমার খুব গর্ব হচ্ছে।’’
জেলা পাশের হারে পিছিয়ে থাকার যে দুঃখ তা অনেকটাই কাটিয়ে দিয়েছে একলব্য। তবে উচ্চমাধ্যমিকের কৃতীরা এবার থেকে প্রাক্তন হয়ে পড়বে, সে জন্যেও কিছুটা হলেও এদিন আনন্দের মধ্যে বিষাদের সুরও ছিল একলব্যতে। স্কুলের এক শিক্ষক মজিবুল ইসলামের কথায়, ওরা বড় বড় কলেজে পড়বে এটা ভেবে ভাল লাগছে। ছুটি পেলেই যাতে ওরা একলব্যতে চলে আসে এদিন ওদের তা বারবার করে জানান শিক্ষকেরা। দ্রুত একলব্যতে বিজ্ঞান বিভাগ চালুর প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। স্কুলের শিক্ষক সংখ্যাও অনেক কম। ১৯ জন শিক্ষকের যেখানে প্রয়োজন সেখানে রয়েছেন মাত্র ৯ জন। দ্রুত শিক্ষক চেয়ে আর্জিও জানানো হয়েছে। শিক্ষক মিললে আরও ভাল ফলকেই পাখির চোখ করার ইচ্ছা রয়েছে বলে জানালেন অধ্যক্ষ অমরজিত সিংহ চহ্নাণ।