দূরত্ব: বছরের শুরুতে আত্মীয়স্বজনদের দেখতে কাঁটাতারের পাশে আসা। ছোঁয়া যায় না। নিজস্ব চিত্র
বাবা কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যেই হাত ঢুকিয়ে দিলেন এই বুঝি সন্তানকে ছুঁতে পারবেন। সন্তানও হাত বাড়িয়েছে। কিন্ত কেউ কারও হাত ছুঁতে পারছে না। নাতিকে দেখা যাচ্ছে ওপার থেকে। বাবা দূর থেকেই আশীর্বাদ করছেন। রমেন রায় জানালেন ছেলে সুনীল কুডি বছর আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি দিয়েছে। অতি আদরের এই সন্তানকে দেখার জন্য প্রতি বছর অপেক্ষা করেন তিনি। এবার নাতিকে দেখলেন। কিন্ত তার পরে মন অতৃপ্ত, কারন তাঁকে ছুঁতে পারলেন না। বললেন, ‘‘ইস ছেলেটাকে একটু আদর করতে পারলাম না।’’
বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন সামিনা বেওয়া। একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধের সময় শেষ বারের মতো পা রেখেছেছিলেন এ দেশের মাটিতে। সেই থেকে ভাই আর বোনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। বছরের এই সময়ের জন্য আসার দিন গুনতে থাকেন। দেখা হবে প্রিয় ভাইটির সঙ্গে। লাঠিতে ভর করে কাঁটাতারের এ পার থেকে ‘‘দাদা, দাদা রে’’ বলে অনবরত ডাকছেন। অনেকক্ষণ পর ওপার থেকে ৬০ বছরের ভাইটি চিৎকার করে বলছেন, ‘‘দিদি আমি এখানে।’’ সঙ্গে সঙ্গে কান্না রোল।
বাড়ি ছেড়ে এসেছেন তখন বয়স দশ এগারো হবে। স্মৃতি আবছা হয়েছে। আর্থিক সঙ্গতির জন্য আসতে পারেননি। উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখর সীমান্তে নিজেদের পরিজনদের সঙ্গে দেখা করলেন ছুটে এলেন মালদহের কালিয়া চকের সত্তর ছুঁইছুঁই মহম্মদ জামাল।
ইসলামপুরের বৃদ্ধা সারবানুর কথায়, ‘‘যখন পানিপথে ছিলাম তখন মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। জামাই ওপারে থাকে। বাংলাদেশে মেয়েকে দেখে আসব সামর্থ্য কোথায়। তাই কয়েক বছর ধরেই সীমান্তে এসে মেয়ে জামাই এর সঙ্গে দেখা করছি।’’ ইসলামপুরের কুন্দরগাঁও-এর গুলাম মুস্তাফার কথায়, ‘‘প্রতি বছরই চেষ্টা করি, আত্মীয়দের সঙ্গে সীমান্তে এসে দেখা করার।’’
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এই ছবি দেখা গেল উত্তর দিনাজপুর জেলার করনদিঘির কোকরাদহ এবং গোয়ালপোখরের নারগাঁও সীমান্তে। এই দুই সীমান্তে প্রতি বছর দুই বাংলার মানুষের বসে মিলনমেলা।
বিএসএফ এবং বিজিবি একটু সুযোগ করে দেয় সীমান্ত বসবাসকারী বাঙালিদের আত্মীয় পরিজনদের দেখা সাক্ষাতের। বছরের এই সময়ে উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া ইসলামপুর, করনদিঘি, গোয়ালপোখর চোপড়া এবং বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় এলাকার সীমান্ত বসবাসকারী মানুষের ঢল নামে। বিএসএফের এক আধিকারিক জানান, ‘‘আমরা মানবিক দিক চিন্তা করে আত্মীয় পরিজনদের দেখা করার সুযোগ দিয়ে থাকি তবে কড়া পাহারাও থাকে।’’
তাই কেউ সঙ্গে নিয়ে আসা ঠান্ডা পানীয় ছুড়ে দেন কাঁটাতারের উপর দিয়েই। কেউ আবার ঢিলে বেঁধে লজেন্স, বেলুন ছুড়ে দিচ্ছে। কিছু পৌছাচ্ছে। কিছু আবার আটকে যাচ্ছে কাটাতারের মাঝেই। মিলনমেলাকে ঘিরে সীমান্তরক্ষী বাহিনীদের কড়া নজরদারি ছিল। সীমান্ত জুড়ে ঘুরেছে টহলদারি ভ্যান।