অচলাবস্থা কথাটা কেবল কাগজেই দেখেছি। তার মানেটা বুঝলাম ছুটি কাটাতে গিয়ে।
ঠিক ছিল, পাহাড়েই যাব। টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পাহাড়ের অচলাবস্থায় ট্রেনই বাতিল হয়ে গেল। কিন্তু এত কষ্টে পাওয়া ছুটি, তাই বাতানুকূল ভলভো বাসেই ডুয়ার্সে যাওয়া ঠিক হল। সন্ধে সাতটার সময় বাসটা কলকাতার ধর্মতলা ছাড়তেই আমরা খুশিতে চিৎকার করে উঠেছিলাম। করুণাময়ী থেকে উঠলেন এক প্রবীণ দম্পতি। তাঁদেরও চোখমুখে খুশি ঝরে পড়ছিল। তাঁরাও অনেক দিন পরে বেড়াতে যাচ্ছেন।
ঘণ্টাখানেক পরেই বাসের এক কর্মী জানিয়ে দিলেন, রাস্তায় কিছু সমস্যা আছে। বাস ঘুরে যাবে। সকাল সাড়ে ছ’টার বদলে শিলিগুড়ি পৌঁছবে সকাল দশটা বেজে যাবে। মনটা খানিক দমে গেলেও বেড়াতে যাওয়া খুশিতে সে সব ভুলেও গেলাম নিমেষে। গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন জানি না। ঘুম ভাঙল তীব্র গরমে। মুর্শিদাবাদে কোনও এক জায়গায় বিকল হয়ে গিয়েছে বাসের এসি। তখন রাত প্রায় দেড়টা। বাস থামিয়ে এসি ঠিক করার চেষ্টা করছিলেন বাসকর্মীরা। বাসের ভিতরে তখন গলদঘর্ম অবস্থা। দমবন্ধ হওয়ার জোগাড়। সহ্য করতে না পেরে আমরা বেশ কয়েকজন নেমে এলাম নীচে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পরেও কাজ হল না। সেই অবস্থাতেই বাস চালু করা হল। তখন বাসের কর্মীরা আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন সমস্যা সামান্যই, সামনে এসি মিস্ত্রি জোগাড় করে বাসের এসি ঠিক করে নেওয়া হবে। কিন্তু সেই মিস্ত্রি আর কখনওই জোগাড় করা যায়নি। বারবার বলার পরেও কিছু ব্যবস্থা করতে পারেননি চালক ও কর্মীরা। এসি বন্ধ থাকায় বাসের ভিতরটা প্রায় গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছিল। বয়স্ক সহযাত্রীরা অসুস্থ বোধ করছিলেন। বাকি সবারই অবস্থাও বেশ খারাপ।
কিন্তু এখানেই দুর্ভোগ শেষ হয়নি। ওই অবস্থাতে যখন আমরা বাগডোগরা পৌঁছই তখন প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। বিহার মোড়ের বেশ কিমি খানেক আগে থেকে যানজটে আটকে পড়ি আমরা। এতদিন এত জায়গায় ঘুরেছি কিন্তু এরকম যানজট দেখিনি। কেউ বলতে পারছে না কেন একরকম যানজট। জিপিএসে দেখা যাচ্ছে জাতীয় সড়ক ধরে পুরোটা জট। প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টা ধরে ওই জটে এসি বিকল হয়ে যাওয়া বাসে বসে থাকতে হয়েছে আমাদের। পরে দেখতে পাই রাস্তার কাজ চলার জন্য রাস্তার প্রায় পুরোটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেটুকু রাস্তা রয়েছে তাতে এত গাড়ি, বাস গেলে যানজট হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু গাড়ির চাপ সামলানোর জন্য নামমাত্র পুলিশ চোখে পড়েছে আমাদের।
ওই পুরো সময়টা আমাদের বাসের দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যে বসে থাকতে হয়। বারবার বলা সত্ত্বেও অন্য কোনও বাসে আমাদের জায়গা দেওয়া হয়নি। এতক্ষণেও কেন এসি চালানো হল বা তা প্রশ্ন করায় আমাদের বাসকর্মীরা জানায় এখানে রাস্তায় ভলভোর এসি সাড়ানোর মিস্ত্রি পাওয়া যায় না। ওই অবস্থাতেই দুপুর প্রায় তিনটে নাগাদ, কুড়ি ঘণ্টা পরে আমরা শিলিগুড়িতে পৌঁছই। বাস সংস্থার অফিসে গিয়ে টাকা ফেরতের দাবি জানালে বলে দেওয়া হয় মাত্র দুশো টাকা দেওয়া হবে। কারণ হিসেবে বলা হয় বাস লেট করলে অতিরিক্ত এসি চালানো হলে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় না।
সাধারণ যাত্রী হিসেবে একটাই প্রশ্ন, যেখানে ট্রেন বন্ধ থাকার জন্যে বাসে করে মানুষেরা যাতায়াত করছে, সেখানে তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্যের ন্যূনতম বিষয়টুকুও কেন দেখা হবে না?