Women's Day

আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়ানোর লড়াই

অমর্ত্য সেন বলছেন— শিক্ষা এবং স্বাক্ষরতার মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করাটাই একমাত্র উপায় সামাজিক লিঙ্গবৈষম্য দূর করার।

Advertisement

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ০৯:২১
Share:

মহানগর ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায়।

সত্যজিৎ রায় ‘মহানগর’ ছবিতে দেখিয়েছিলেন এক নতুন নারীকে। বন্ধ কারখানার শ্রমিকের স্ত্রী সেই মেয়েটি অর্থ উপার্জনের জন্য চৌকাঠ পেরোয়। জীবনের প্রথম স্বাধীন উপার্জন হাতে পেয়ে তার আত্মপরিচয়ের আলোয় উদ্ভাসিত মুখখানায় সাদাকালো ফ্রেম থেকে উপচে আসা অস্মিতা চুঁইয়ে পড়ে— যখন মেয়েটি গন্ধ নেয় নতুন নোটগুলির। নতুন পরিচয়ের। প্রায় ছ’দশক পেরিয়ে আসা দৃশ্যটি ফ্রিজশট হয়ে থাকে বুকের ভিতর! স্তব্ধ করে রাখে, যতবার দেখি!

Advertisement

ষাটের দশকের পৃথিবীটা সেলুলয়েডে যতটা দূরের দেখায়, অন্তরমহলে উঁকি দিলেও কি তা ঠিক ততটাই অচেনা এই ডিজিটাল বিশ্ব তথা দেশ তথা রাজ্য বা আমাদের নিজস্ব অঞ্চলে? কর্মরত মেয়েরা কেমন আছি এখন আমরা? কিছুদিন আগেও যখন কোনও সরকারি সমীক্ষায় টিক চিহ্ন দেওয়া হত গৃহবধূ, বেকার বা চাকুরিজীবীর সঙ্গে— তখন অনেক তলিয়ে দেখে অদ্ভুত একটা দ্বৈত খুঁজে পেতাম। ‘গৃহবধূ’ আর ‘বেকার’— এই দু’টি যদি ‘অপশন’ হয়, তবে গৃহবধূ হওয়াটিকে তো পেশা হিসেবে মান্যতা দেওয়াই হল। বেশ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অহং-পূরণ হল। ভালই। কিন্তু গার্হস্থ্যশ্রম আমাদের সমাজে সত্যিই কি শ্রমের মর্যাদা পায়? তা হলে উচশিক্ষিত গৃহবধূটি কেন সসঙ্কোচ বলে---‘আমি কিছুই করি না। জাস্ট হাউসওয়াইফ’! তার কারণ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাব। যে স্বোপার্জিত শাকান্নের জন্য ভাতঘুম ছেড়ে বহু মেয়ে পথে নেমেছে, সে তৃপ্তির স্বাধীনতা সেই মেয়ে পায়নি। আর বিবাহও যে একটি পেশা হয়ে উঠতে পারে, সেটাই তাকে বোঝানো হয়। সে খুব ভিতর থেকে বিপন্ন আর বিষণ্ণ বোধ করতে করতে একদিন মুক্তির আকাশ খুঁজতে চায়। সবাই তা পায় না। পেতে দেওয়া হয় না তাকে। তাই ‘কর্মরত মেয়ে’দের নিয়ে সমাজের কৌতুহল আর কৌতুক উভয়ই জারি থাকে।

অমর্ত্য সেন বলছেন— শিক্ষা এবং স্বাক্ষরতার মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করাটাই একমাত্র উপায় সামাজিক লিঙ্গবৈষম্য দূর করার। যে মেয়েটি বাইরের কাজের জগতে পা রেখেছে, সে না হয় পরিবারে অপরতার জায়গা অতিক্রম করে প্রবল স্বর ও অস্তিত্ব হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তার কাজের জায়গাটা? সেখানে আবার কেউ কেউ অন্য রকম পুরুষতন্ত্রের শিকার বা লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে না তো? কোনও হেনস্থা বা অবদমনের বা অন্যায়ের ‘সফট টার্গেট’? কর্মরত মানেই আমরা কেন যেন ধরে নিই মধ্যবিত্ত পরিবারের চাকুরিরত মেয়েদের কথা। আর যারা শিক্ষাগত যোগ্যতায় কর্মে নিযুক্ত নয়, যেমন গৃহ-সহায়িকা, আয়া, বিভিন্ন চেম্বারে বা ডেস্কে সহায়িকার ভূমিকায় অথবা আরও অজস্র পরিশ্রমসাধ্য কাজে— তারা যে শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য কতখানি বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার, তা আমরা, শহুরে ভদ্দরলোকেরা উপেক্ষা করি। এই মেয়েদের অনেকের বাড়িতেই শুধু তার উপার্জনেই সংসার চলছে। বাবা, দাদা বা স্বামী মাসান্তে সবটুকু রোজগার কেড়ে নিয়ে এমনকি দৈহিক ভাবেও অত্যাচার করে থাকে। তার পর কাজের জায়গায় হয় সহ্য করো, নয় সরে যাও গোছের চুক্তি। আমি নিজের যে পরিবার-পরিমণ্ডলে আছি, পরিচিত বহু বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীর পরিবারেই তার উলটো ছবি বা সহমর্মিতার উদাহরণ কিছু কম নেই। তবু এই আপাত-জানার আড়ালে অনেক অনেক না-জানা অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে, থাকে। কর্মসূত্রে বাড়ি থেকে, সংসার থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হওয়া বহু মেয়েকেই শুনতে হয় কাজ ছাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি বা সংসারে তার কোন ভূমিকা নেই বলে ব্যঙ্গোক্তি। মেয়েটির কাজকে তুচ্ছ করে দেখার এক মানসিকতা কি ক্রিয়াশীল কোথাও, সম্ভব হলেই যে কাজ ‘ছাড়িয়ে’ দেওয়া যায়, তা সে অর্থমূল্য বা সম্মানে যতই গুরুগম্ভীর হোক না কেন! উলটো সম্ভাবনাটা কিন্তু একই রকম মসৃণ নয়। মানে, পুরুষটির কাজ ছাড়িয়ে দেওয়া। বহু বহু পুরুষও তো কর্মসূত্রে বাড়ি ছেড়ে বাইরে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকতে বাধ্য হয়। তাদেরও কি একই ভাবেই মাপা হয়?

Advertisement

আন্তজার্তিক মহিলা দিবসে এই বিশেষ দিনগুলি সম্পর্কে জানেন?

যে সমস্ত মেয়েরা শিক্ষকতা বা অন্যান্য অফিসকাজে রয়েছে, তাদের একটা বড় অংশ প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এটা কি এই জন্য যে, বহু বছর ধরে শাসিত হতে হতে, শোষিত হতে হতে মেয়েরা বুঝেছে, ক্ষমতা হাতে থাকলে তবেই কিছু কাজ করা সম্ভব! গঠনমূলক কিছু করার জন্য ক্ষমতা জরুরি। তাই অবচেতনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেয়েও বেশি কাজ করে প্রশাসনিক পদমর্যাদা আর ক্ষমতার প্রতি মুগ্ধতা। এই ক্ষমতা স্বাধীনতার সমার্থক। আর প্রশাসনিক পদে বিভিন্ন স্তরে থাকা মেয়েরা, তারা কী বলছে?— ‘জানো, যখন জয়েন করলাম আয়কর দফতরের আধিকারিক হয়ে, বয়স একদম কম। চেহারাও ভারিক্কি না। অচেনা শহরে পোস্টিং। এক অফিসে গিয়েছি অধস্তনদের নিয়ে। শুনতে হয়েছিল, মেয়েছেলেদের সঙ্গে কথা বলব না। তার পর ক্লারিক্যাল পোস্টে থাকা বয়স্ক পুরুষটিকেই কাগজপত্র দেখাতে থাকে তারা!’— এই অভিজ্ঞতা উচ্চপদে কর্মরত এক বাল্যবন্ধুর। স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে মেয়েরা আসতে চায় মূলত এই প্রশাসনিক কাজের প্রতি ভালবাসা থেকেই। কিন্তু যদি স্কুলটি হয় কো-এড বা বয়েজ স্কুল? সেখানে যদি কোনও মেয়ে প্রধানের পদে যায়? ইগোর লড়াই অবধারিত। আইন আছে, প্রধানের হাতে ক্ষমতাও আছে, কিন্তু ফাঁকফোকরও আছে। তা কাজে লাগিয়েই মেয়েদের কর্তৃত্ব উপেক্ষা করা হয় অনেক সময়ই— সে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হলেও। বিপরীত ছবিও আছে। পারদর্শিতার সঙ্গে স্কুল-কলেজ-অফিসে প্রধানের দায়িত্ব সামলানো মেয়েরা তো আছেই। কিন্তু সেই তারা নিজেরাই শুধু জানে, তাদের দেখেও না দেখা, উপেক্ষা করা কতশত কাঁটা ঘরে-বাইরে টপকে যেতে হয়! (শেষাংশ আগামিকাল)

(লেখক ময়নাগুড়ির খাগড়াবাড়ি

উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন