তোতারাম বস্তিতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীকে ঘিরে ক্ষোভের কথা জানাচ্ছেন বাসিন্দারা। —নিজস্ব চিত্র।
গরু পাচারের অভিযোগকে ঘিরে সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি) এবং একদল গ্রামবাসীদের মধ্যে সোমবার সংঘর্ষের পরে মঙ্গলবারেও উত্তেজনা রয়েছে নকশালবাড়িতে। সোমবার গুলিতে একজনের মৃত্যু হয়। চার জন গুলিবিদ্ধ হন। মঙ্গলবার সকালেই এলাকা গিয়ে দলীয় দফতরে বসে এলাকাবাসীর কাছ থেকে পুলিশ এবং এসএসবি-র বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। জেলা পুলিশ সুপারকে টেলিফোন করে কড়া পুলিশি নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেন। এর পরে কয়েকশো বাসিন্দাকে নিয়ে ঘটনাস্থল তোতারাম জোতে যান।
সেখানে জমায়েতে অনেকেই মাথায় কালো কাপড় বেঁধে প্ল্যাকার্ড সিপিএম, বিজেপি এবং এসএসবি-র বিরুদ্ধে স্লোগানও দেন। সেখানে পুলিশের সামনেই ঘটনায় অভিযুক্তদের অনেকেই ঘোরাঘুরি করছিলেন বলে অভিযোগ। মন্ত্রীর কাছে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া দুটি গুলির খোল জমা দেওয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রী গুলিতে নিহত তৃণমূল চালক সংগঠনের সদস্যের বাড়িতে না যাওয়ায় সংগঠনের একাংশের মধ্যে ক্ষোভও দেখা দেয়। মন্ত্রী গাড়িতে উঠতেই অনেকেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। দুপুরে দেহটি আনার সময় সাতভাইয়া মোড়ে ৩১-সি জাতীয় সড়কও মিনিট দশেক অবরোধও করা হয়।
ঘটনার পর রাতে দোকানপাটেও হামলা, গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে একদল দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে। মন্ত্রী নকশালবাড়িতে গেলেও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা না বলায় ব্যবসায়ীদের একাংশও ক্ষুব্ধ। গোটা ঘটনার প্রতিবাদে আজ, বুধবার নকশালবাড়িতে ২৪ ঘন্টা ব্যবসা বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে বলে নকশালবাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনিল সাহা জানিয়েছেন। সিপিএমের তরফে বন্ধকে সমর্থন করা হয়েছে।
গত সোমবার ভক্তিনগরের লিম্বুবস্তিতে সরকারপাড়ার যুবক দীপঙ্কর রায়ের খুনের পর সেবকরোড এলাকায় প্রায় ৬ ঘন্টা ‘তান্ডব’ চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূল সমর্থক একদল যুবকের উপর। তৃণমূল নেতৃত্ব এলাকায় গিয়ে বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়ানোর পর পরিস্থিতি আরও ঘোরাল হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ। পুলিশের সামনেই দোকান, বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এদিনও নকশালবাড়িতে গ্রামবাসী এবং একাংশ অভিযুক্তদের পাশে গিয়ে সাত সকালে তৃণমূল নেতৃত্বের দাঁড়ানোর ঘটনার মধ্যে ভোটের রাজনীতি দেখছেন বিরোধীরা।
তাঁদের অভিযোগ, শিলিগুড়িতে পুরসভা এবং পঞ্চায়েত ভোট আসন্ন। ভালমন্দ বিচার না করে এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাখতে সবার আগে পৌঁছে যাচ্ছেন নেতারা। এদিনও নকশালবাড়িতে একই দৃশ্য দেখা দিয়েছে। মন্ত্রী যাওয়ার পরেও তোতারাম জোতে তৃণমূল নেতাদের ঘাঁটি গেড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর দাবি, “এসএসবি-র আইজি ঘটনা জানতেনই না বলে রাতে আমাকে বলেছেন। আশ্চর্য ব্যাপার! তবে পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলিও দেখা হবে। নিহতের পরিবারকে কীভাবে ক্ষতিপূরণের দিকটি দেখা হবে। শান্তি শৃঙ্খলার উপর সবসময় জোর দিতে হবে। বন্ধ কোনও সমস্যার সুরাহা নয়।” মন্ত্রীর দাবি, “আমাদের স্থানীয় নেতৃত্ব ঘটনার পর থেকে এলাকায় আছেন। আগাম কিছু অনুষ্ঠান থাকায় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জখমদের দেখে এলাকা ঘুরে এসেছি। এর মধ্যেই নিহতের বাড়িতে যাব। এটা কোনও রাজনীতি নয়।”
বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, নকশালবাড়ির নেপাল সীমান্তের গরু পাচার-চোরা চালানকারীদের বরাবর ‘স্বর্গরাজ্য’ বলে চিহ্নিত। নেপাল থেকে বিভিন্ন চোরাপথে গরু, সুপারি-সহ বিভিন্ন পণ্য এপারে আনা হয়। এক হাজার টাকায় গরু ওপার থেকে এনে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। পুলিশ, এসএসবি-র একাংশ লেনদেনে জড়িত বলেও অভিযোগ। চোরাকারবারীদের বাড়বাড়ন্তের অভিযোগ করেছেন বিজেপির জেলা সভাপতি রথীন বসু। তিনি বলেন, “এলাকার গরু পাচার, দুষ্কৃতীদের রমরমা। শাসক দলের নেতাদের কয়েকজন রাজনীতি নিয়ে এত ব্যস্ত যে ভালমন্দ কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। আমরা এলাকায় মিছিলও করেছি।”
পুলিশ সূত্রের খবর, সোমবার রাতেই তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসএসবি’র অভিযোগের ভিত্তিতে জওয়ানদের খুনের চেষ্টা, দাঙ্গা, শ্লীলতাহানি, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট এবং কাজে বাধার মত একাধিক ধারায় পুলিশ মামলা রয়েছে। অভিযুক্তদের তালিকায় শাসক স্থানীয় তৃণমূলের নেতা ছাড়াও সিপিএমের নেতাদেরও নাম রয়েছে। একই ধরণের অভিযোগ নিয়ে নকশালবাড়ির থানার এক পুলিশ অফিসার এবং গুলিবিদ্ধ মহিলা মেহেরজান খাতুনের ছেলের হামলার অভিযোগের ভিত্তিতেও মামলা হয়েছে। দার্জিলিঙের পুলিশ সুপার অখিলেশ চর্তুবেদী বলেন, “তিনটি মামলা হয়েছে। তদন্ত হচ্ছে। ঘটনার অভিযুক্তদের অবশ্যই ধরা হবে।”
এসএসবি-র শিলিগুড়ি ফ্রন্টিয়ারের আইজি কুলদীপ সিংহ এদিন বলেন, “তোতারামে পাচারকারীরা এলাকায় ২০০ উপর গরু জড়ো করেছিল। অভিযানে গেলে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েও জওয়ানদের উপর হামলা হয়। অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। বাধ্য হয়ে ৮ রাউন্ড শূন্যে গুলি চালাতে হয়েছে। আমাদের ৯ জন আহতও হন।”
ঘটনার পর অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে দোষারোপের পালাও শুরু হয়েছে। যেমন মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির কংগ্রেস বিধায়ক শঙ্কর মালাকার বলেন, “এসএসবি গুলি চালিয়ে ভাল কাজ করেনি ঠিকই। কিন্তু তার পরে যা হয়েছে সবটাই পুলিশ-প্রশাসন তো বটেই তৃণমূল নেতাদের ব্যর্থতা।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকারের দাবি, “মিথ্যা মামলায় আমাদের লোকজনকে এখানেও ফাঁসানো হচ্ছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, চোরাচালান-পাচার বন্ধ না করে তৃণমূল রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত।” যদিও নকশালবাড়ির অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি তপন কুন্ডু, ব্লকের নেতা পৃথ্বীশ রায়দের দাবি, “আমরা মানুষের পাশে রয়েছি। কোনও রাজনীতি করছি না। আর বন্ধ ডেকে কোনও সমস্যা মেটে না।”