কবির মালতীলতা আঁকড়ে বিষণ্ণ প্রতীক্ষায় এক ভক্ত

রাতভর তুলকালাম ঝড়বৃষ্টির পরে তেজী রোদের সকাল। বাগানের ঘাসে তখনও লেগে আগের রাতের চিহ্ন। বাড়ির বন্ধ দরজার ভিতর থেকে ভেসে আসছে উদাত্ত কণ্ঠের ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’! আসবাবের ভারহীন ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা লেগে সে সুরের অনুরণন আরও প্রবল হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে বাইরে, পার্বত্য প্রান্তরে।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

মংপু শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৪ ০১:৪৭
Share:

সেই কেয়ারটেকার শিশির রাউত। —নিজস্ব চিত্র।

রাতভর তুলকালাম ঝড়বৃষ্টির পরে তেজী রোদের সকাল। বাগানের ঘাসে তখনও লেগে আগের রাতের চিহ্ন। বাড়ির বন্ধ দরজার ভিতর থেকে ভেসে আসছে উদাত্ত কণ্ঠের ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’! আসবাবের ভারহীন ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা লেগে সে সুরের অনুরণন আরও প্রবল হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে বাইরে, পার্বত্য প্রান্তরে।

Advertisement

আগন্তুকের ডাকে দরজা খুলে দিয়ে গায়ক যখন বাইরে এসে দাঁড়াবেন, গলায় সেই সুরের আনন্দ উধাও! বরং, বিষাদ। “আসুন, দেখুন! দেখুন যদি কিছু করা যায়!” ঝকঝকে বাংলা উচ্চারণে কাতর আর্জি মধ্যবয়সী নেপালি ভদ্রলোকের গলায়।

ইনি শিশির রাউত। দার্জিলিঙের মংপুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির একমাত্র কেয়ারটেকার। যে বাড়ির নাম রবীন্দ্র ভবন হওয়ার পর থেকে তিনি ‘ইনচার্জ’ও বটে। তবে আর পাঁচ জন প্রথাগত রবীন্দ্রানুরাগীর সঙ্গে তাঁর ফারাক বিস্তর। প্রায় ৭৫ বছর আগে বৃদ্ধ রবি ঠাকুরকে পালকি চাপিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে মংপুর এই বাড়িতে তুলে আনতেন যে চার জন, তাঁদের মধ্যে এক জন ছিলেন ভীমলাল রাউত। সে দিনের সেই পালকি-বাহকের নাতি শিশির দাদুর কাছে বিশ্বকবির গল্প শুনেছিলেন। সেই থেকে জন্মানো ভালবাসার টানেই আজও মংপুর বাড়িতে রবিবাবুর স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে আছেন। এবং তাঁর সঙ্গী এখন বিপুল আক্ষেপ। রবীন্দ্রনাথের বহু স্মৃতি, ব্যবহৃত বহু জিনিস নষ্ট হতে বসেছে সময়ের আক্রমণে। বিশেষজ্ঞদের সাহায্য ছাড়া যে স্মৃতিরক্ষা বেশি দিন আর সম্ভব নয় বলেই বিষাদগ্রস্ত শিশির।

Advertisement

ইতিহাস বলছে, মংপুর এই বাড়ি রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর সৌজন্যে। তাঁর চিকিৎসক-স্বামী সেই সময়ে দার্জিলিঙে কুইনাইন ফ্যাক্টরির সঙ্গে যুক্ত। মংপু তখন এখনকার মতো মোটর-পথে সুগম নয় মোটেও। গাড়িতে যত দূর আসা যেত, সেখান থেকেই অশক্ত শরীরের রবীন্দ্রনাথকে পালকিতে ১২ কিলোমিটার রাস্তা উজিয়ে নিয়ে আসা হত মংপুতে। শিশিরের কথায়, “আমার দাদু সেই পালকি বয়েছিলেন। আমি নেপালি কিন্তু মনে মনে বাঙালি। তবু বাঙালি বলতে আজকাল লজ্জা হয়! এত মূল্যবান স্মৃতি সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু করবে না?”

মংপুর এই বাড়িতে লেখার পাকা সরঞ্জামের অভাবে অনেক সময়েই কুইনাইন ফ্যাক্টরির বরোয়িং শিটে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। মৈত্রেয়ীদেবীই সে সব পাণ্ডুলিপি যথাসম্ভব পেরেছেন, সংগ্রহ করে গুছিয়ে রেখেছেন। মংপুর রবীন্দ্র ভবন সংগ্রহশালার মর্যাদা পাওয়ার পরে সে সব প্রদর্শনের ব্যবস্থাও হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা চিঠি, নিজের হাতে আঁকা ছবি বিশেষজ্ঞদের পরিচর্যা না পেলে বাঁচানো যাবে কত দিন? শিশির বলছেন, “১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত চার বার এই বাড়িতে এসেছেন কবিগুরু। তাঁর ব্যবহৃত খাট, চেয়ার, ছবির ইজেল রাখার স্ট্যান্ড, বেঁচে যাওয়া রঙের শিশি, এত ছবি সবই যতটা পেরেছি, বাঁচিয়েছি। কিন্তু এগুলো এমনি এমনি এ ভাবে কতটা বাঁচানো যায়? কেউ যদি দায়িত্ব না নেয়, কী ভাবে চলবে?”

বামফ্রন্ট সরকার রবীন্দ্রনাথের এই পার্বত্য নিবাসকে সংগ্রহশালা করার ঘোষণা করেছিল। তার পরেও পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই এই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে সাড়ে তিন কোটি টাকার অনুদান দেওয়া হয় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের মাধ্যমে। বাড়িটির এখনকার আলোকসজ্জার ব্যবস্থা হয়েছে রাজ্য সরকারের ওই অনুদানেই। কিন্তু শিল্প ও সংস্কৃতির দিক থেকে যে স্মৃতিরক্ষার কথা শিশির বলছেন, বিশেষজ্ঞদের ভমিকা ছাড়া সে কাজ সমস্যাসঙ্কুল। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চর্চার জন্যই দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় যখন রয়েছে, তারা কি দায়িত্ব নিতে পারে না প্রশ্ন শিশিরের। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বর্ষীয়ান অধ্যাপকের বক্তব্য, “সমস্যাটি সম্পর্কে আমরাও সম্প্রতি আলোচনা করেছি নিজেদের মধ্যে। এই ধরনের কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের যে হেতু দক্ষতা বেশি এবং তারা অর্থও খরচ করতে পারে, তাই বিশ্বভারতী এগিয়ে এলেই বোধহয় ভাল হয়।”পারিবারিক সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের মংপু-পর্ব সম্পর্কে বিশেষ অবহিত রাজ্যের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আনন্দবাজারের কাছে সমস্যার কথা শুনে শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস, “এটা শুধু ওই বাড়ি নয়, পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রশ্ন। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই কিছু দায়িত্ব পালন করেছে। আরও নির্দিষ্ট নিছু প্রস্তাব এলে নিশ্চয়ই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে করণীয় ঠিক করব।”

সাহায্য আসার আগে যন্ত্রণা নিয়েই দায়িত্ব পালন করে যাবেন শিশির। সময়ের ঝাপ্টা সামলে বাগানে রয়ে-যাওয়া গাছটা দেখিয়ে জানাবেন ‘ওই মালতীলতা দোলে’ গানটার সৃষ্টি রহস্য। অতিথিকে বিদায় দিয়ে বন্ধ দরজার ও’পারে আবার উদাত্ত হবে নেপালি কণ্ঠে বাংলা সুর ‘পুরানো সেই দিনের কথা’...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন