তোলাবাজির দৌরাত্ম্যে মদত রাজনৈতিক দলের, অভিযোগ

মুখগুলো সেই একই। শুধু বদলে গিয়েছে দলের পতাকা। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট বাজার এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের দাবি, এখানে তোলাবাজির দৌরাত্ম্য অনেকদিনের। তফাতের মধ্যে আগে তোলাবাজদের পতাকার রং ছিল লাল। রাজ্যে ক্ষমতার হাতবদলের পরে ঘাসফুলের পতাকার মিছিলে ভিড়ে গিয়ে আরও যেন উদ্ধত হয়ে ওঠে তারা। অভিযোগ, নেতাদের একাংশের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের ওই যোগসাজশ দেখে পুলিশও হাত গুটিয়ে রয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বালুরঘাট শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৪ ০২:২৮
Share:

মুখগুলো সেই একই। শুধু বদলে গিয়েছে দলের পতাকা।

Advertisement

দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট বাজার এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের দাবি, এখানে তোলাবাজির দৌরাত্ম্য অনেকদিনের। তফাতের মধ্যে আগে তোলাবাজদের পতাকার রং ছিল লাল। রাজ্যে ক্ষমতার হাতবদলের পরে ঘাসফুলের পতাকার মিছিলে ভিড়ে গিয়ে আরও যেন উদ্ধত হয়ে ওঠে তারা। অভিযোগ, নেতাদের একাংশের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের ওই যোগসাজশ দেখে পুলিশও হাত গুটিয়ে রয়েছে। তোলা আদায়কারীদের অত্যাচারে তিতিবিরক্ত হয়ে একাধিক ব্যবসায়ী বাজার থেকে দোকান তুলে অন্যত্র চলে গিয়েছেন বলেও ব্যবসায়ী সংগঠন জানিয়েছে। সে কারণেই তিলতিল করে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে ভুক্তভোগীদের মধ্যে। সেই ক্ষোভ আরও বাড়ে যখন বুধবার তোলাবাজদের পাণ্ডা বলে সন্দেহভাজন খোকন কর্মকার ও তার সঙ্গীরা বাজারে নিহত ব্যবসায়ী পরিতোষ দে-র আবক্ষ মূর্তিকে মদ ঢালে, প্রস্রাব করে। পরিতোষবাবু তোলাবাজির প্রতিবাদ করাতেই খুন হয়েছিলেন। এর পরেই ক্ষোভে ঘৃতাহুতি পড়ে। ওই দিন সন্ধ্যায় ফের তোলাবাজি করতে গেলে খোকনকে পিটিয়ে কুপিয়ে খুন করে ক্ষিপ্ত জনতা।

খোকন খুন হওয়ার পরে বাম নেতাদের একাংশের ভূমিকা নিয়ে যেমন ফের নানা অভিযোগ সামনে এসেছে। তেমনই তৃণমূলের নেতাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধেও খোকন ও তাঁর দলবলকে ‘মাথায় তোলার’ অভিযোগ উঠছে। যা শোনার পরে সিপিএম-আরএসপি বনাম তৃণমূলের চাপানউতোরও শুরু হয়েছে।

Advertisement

বালুরঘাট বাজার ও লাগোয়া এলাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা অনেক ঘটনার সাক্ষী। যেমন, অনেকে জানিয়েছেন, নিহত খোকন ডিওয়াইএফের সদস্য হিসেবে এলাকায় ‘দাদাগিরি’ শুরু করেছিল। সিপিএমের মিছিলে ঝান্ডা নিয়ে ঘোরার সুবাদে তারা দাপিয়ে বেড়াত। হুমকি, শাসানি, মারধর তো জলভাত, দিনেদুপুরে একাধিক খুনের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল খোকনের। ব্যবসায়ী, ও বাসিন্দাদের অনেকের অভিযোগ, বাম নেতাদের একাংশের মদতে বাজার থেকে ফি মাসে অন্তত ২০ লক্ষ টাকা তোলা আদায় করা হত। এ ছাড়া, জমি-বাড়ি কেনাবেচা, তৈরির ক্ষেত্রেও ‘কমিশন’ আদায়ের মাধ্যমে ফি বছরে গড়ে কোটি টাকা আদায় হত বলে দাবি করছেন অনেকে। সেই টাকার একাংশ বাম আমলে শাসক দলের সম্মেলন, ভোটের সময়ে নানা দখলদারির কাজে ব্যবহার হত বলে তৃণমূলের অভিযোগ। এমনকী, বাম জমানায় বালুরঘাট থানার এক ওসি সৌম্যজিৎ রায় খোকন ও তাঁর দলের কয়েকজনকে গ্রেফতার করায় তাঁকে রাতারাতি বদলি করে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসায়ী মহলের অভিযোগ, ২০১১ সালে তোলাবাজির প্রতিবাদ করে মাছ ব্যবসায়ী পরিতোষ দে খুন হলে খোকনের নামেও এফআইআর হয়। কিন্তু, চার্জশিটে খোকনের নাম ছিল না।

একদা খোকনকে কাছ থেকে দেখেছেন, এমন একজন প্রবীণ সিপিএম নেতা জানান, বছর দশেক আগে বালুরঘাটের আরএসপি কার্যালয়ের সামনে এক যুবক খুনের ঘটনায় খোকনের নাম জড়ায়। সেই সময়ে তাঁর ডিওয়াইএফের সদস্য পদ বাতিল করা হয়। ওই নেতা জানান, তা সত্ত্বেও খোকনকে দল থেকে পুরোপুরি দূরে রাখা যায়নি। সিপিএমের দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা সম্পাদক মানবেশ চৌধুরী অবশ্য দাবি করেছেন, “খোকনদের সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক ছিল বলে জানা নেই। বরং এলাকার তৃণমূলের ওয়ার্ড কাউন্সিলারের সঙ্গে খোকনকে বেশি দেখা যেত।”

বাম শরিক আরএসপির অনেক নেতা সেই সময়ে খোকনের সঙ্গে সিপিএম নেতাদের কয়েকজনের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে দাবি করেছেন। তবে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে চাননি। বালুরঘাট পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারপার্সন তথা আরএসপি নেত্রী সুচেতা বিশ্বাস বলেন, “খোকনের সঙ্গে আরএসপির সম্পর্ক ছিল না। বরং ওদের তোলাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীরা স্মারকলিপি দিলে আমরা সামিল হয়েছিলাম।”

ঘটনা হল, বাম আমলে যে সব অভিযোগ সিপিএম, আরএসপি নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে উঠেছিল, এখন তা-ই শোনা যাচ্ছে তৃণমূলের কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের কয়েকজন জানান, গত বিধানসভা ভোটের পরে ধীরে ধীরে খোকন ও তাঁর দলবল তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। গত পুরভোটে খোকনকে তৃণমূলের হয়ে মিটিং-মিছিল, বুথে বুথে ঘুরতে দেখেছেন অনেকেই। ইদানীং খোকনের চার সঙ্গী তথা পরিতোষ দে খুনের মামালায় সাজাপ্রাপ্ত ৪ জন জামিনে মুক্তি পেলে অত্যাচার মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ। এলাকার তৃণমূল নেতাদের কয়েকজনের কাছে খবর পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি বলেও ব্যবসায়ীদের কয়েকজন অভিযোগ করেছেন।

তবে তৃণমূলের দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্র দাবি করেন, “বাম আমলে পরিতোষবাবু খুন হন। আমরা রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে পুলিশ সক্রিয় হওয়ায় সেই মামলায় ৬ জনের সাজা হয়। খোকনদের গীতাঞ্জলি ক্লাবটিও সিল করে দেওয়া হয়।” এত সবের পরেও খোকন ও তাঁর দলবল ফের দৌরাত্ম্য চালাচ্ছিল কী ভাবে? এলাকার তৃণমূল কাউন্সিলর রাজেন শীলের বিরুদ্ধে কেনই বা খোকনদের মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলছে সিপিএম? রাজেনবাবুর যুক্তি, “এলাকার ছেলে হিসেবে চিনতাম। রাজনৈতিকভাবে খোকনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না।”

তোলাবাজি বন্ধের দিকে নজর না দিয়ে নেতাদের চাপানউতোর দেখেই হয়তো পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ গোপন বোঝাপড়াও করে নেয় বলে সন্দেহ ভুক্তভোগীদের। বালুরঘাট ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক হরেরাম সাহা বলেন, “সকলেই সব কিছু জানেন। বোঝেন। তোলাবাজরা কতটা বেপরোয়া সেটা পরিতোষবাবুর মূর্তিতে মদ ঢালা, প্রস্রাব করা থেকে স্পষ্ট। এতে জনরোষ বাড়তেই পারে।”

দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার শিসরাম ঝাঝারিয়া বলেন, “আমি সবে দায়িত্ব নিয়েছি। আগের ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। বুধবারের ঘটনায় ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তোলা আদায়ের ব্যাপারে তদন্তে নেমে কয়েকজনকে জেরা করা হচ্ছে।” ঘটনাচক্রে, পুলিশ খোকন খুনের মামলায় যে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে, তাঁরা মাছ ব্যবসায়ী। নিহতের স্ত্রীর অভিযোগপত্রে অবশ্য তাঁদের নাম নেই। তাতে এলাকার মাছ ব্যবসায়ীদের মধ্যে ফের ক্ষোভ দানা বাঁধছে। ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের প্রশ্ন, বালুরঘাটে তোলাবাজির উপদ্রব কী চলবেই?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন