জলপাইগুড়ির সভায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সৈকত চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সন্দীপ পাল
জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানার নথি বলছে, পুলিশকর্মীকে রাস্তায় চড় মারার মামলায় তৃণমূল যুব কংগ্রেসের জেলা সভাপতি সৈকত চট্টোপাধ্যায় ‘ফেরার।’ সোমবার সেই সৈকতকেই দেখা গেল, দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো তথা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, একই মঞ্চে। সেখানে সৈকত ‘খাদা’ (সম্মান জানাতে যে উত্তরীয় পরান নেপালিরা) পরিয়ে অভিষেককে অভ্যর্থনা জানান। দুজনকে মঞ্চে পাশাপাশি বসে কথা বলতেও দেখা যায়।
এ হয়তো আশ্চর্য নয়। তৃণমূলেরই এক নেতা একান্তে বললেন, “বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল যদি ‘পুলিশকে বোম মারুন’ বলার পরেও মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থাকতে পারেন, তা হলে পুলিশকে চড় মারার পর জলপাইগুড়ি যুব তৃণমূল জেলা সভাপতি সৈকতই বা মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোকে মঞ্চে অভ্যর্থনা জানাতে পারেন না কেন?” কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার-কর্মীদের একাংশ অবশ্য তেমন যুক্তিতে ভুলছেন না। তাঁরা ক্ষোভে ফুঁসছেন। ক্ষুব্ধ পুলিশকর্মীদের অভিযোগ, এ ভাবে নেতারা পুলিশ-নিগ্রহে অভিযুক্তদের মাথায় তোলেন বলেই আলিপুর-সহ নানা এলাকায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ক্রমেই বাড়ছে।
শুধু তা-ই নয়, যে কনস্টেবলকে সৈকতবাবু চড় মেরেছিলেন বলে অভিযোগ, সেই নৃপেন পালচৌধুরীর স্ত্রীও হতাশ। কারণ, নৃপেনবাবুর স্ত্রী তাঁর স্বামীকে মারধরে অভিযুক্তের শাস্তি চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন। পারিবারিক সূত্রের খবর, এদিন জলপাইগুড়িতে সভায় মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর সঙ্গে সৈকতবাবুর ঘনিষ্ঠতা দেখে নৃপেনবাবু ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই স্তম্ভিত। বিষয়টি নিয়ে নৃপেনবাবুর স্ত্রী ফের মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। জলপাইগুড়ির জেলা পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল ফোন ধরেননি। তবে জেলা পুলিশের একাধিক অফিসার দাবি করেছেন, পুলিশ-নিগ্রহে অভিযুক্তের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো এক মঞ্চে বসায় তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে।
পুলিশ ও দলীয় সূত্রে খবর, অভিষেকের সঙ্গে ‘ফেরার’ সৈকতকে একই মঞ্চে দেখা গেলে বিতর্ক তৈরি হতে পারে, আশঙ্কা করে জেলা পুলিশের এক শীর্ষস্থানীয় কর্তা আগেই যোগাযোগ করেন নবান্নের সঙ্গে। প্রকাশ্য সভায় সৈকতকে দেখা গেলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার না করলে প্রশ্ন উঠতে পারে, তা-ও জানিয়ে দেন তিনি। এর পরেই নবান্ন থেকে বিষয়টি জানানো হয় অভিষেককে। দল সূত্রের খবর, দুপুরে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে অভিষেকবাবু বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবরও নেন। তবে শেষ পর্যন্ত মঞ্চেই দেখা যায় সৈকতবাবুকে।
সৈকতের মঞ্চে থাকার বিষয়টি নিয়ে দলের অন্দরেও ক্ষোভ দানা বাঁধে। দলের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী ‘বিচারাধীন বিষয়’ নিয়ে মন্তব্য করবেন না বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি বিশদে খোঁজখবর না নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারব না।”
যাঁর বিরুদ্ধে পুলিশকে চড় মারার অভিযোগ, সেই সৈকতের দাবি, “আমি কলকাতা হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেয়েছি।” কিন্তু, জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানার নথি জানাচ্ছে, তিনি ফেরার। তা হলে জামিন হল কী করে? সৈকতের যুক্তি, “আমি থানায় এখনও জামিনের বিষয়টি জানাইনি।”
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে এ দিনই উত্তরবঙ্গ সফরে পৌঁছেছেন অভিষেক। প্রথম দিনই বিতর্কের মধ্যে পড়েছেন। ওই ঘটনার পরে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার কাছে খবর, সৈকত জামিন পেয়েছেন। ওর কাছে সব আইনি নথি রয়েছে।” সৈকত অত্যন্ত দক্ষ সংগঠক বলেও দাবি করেন অভিষেক। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “এ দিনের সভা খুব সফল হয়েছে বলেই এ সব অপপ্রচার চলছে।”
জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, গত ১৭ জুলাই শহরের দিনবাজার এলাকায় গাড়ি দাঁড় করানো নিয়ে গোলমালের সময়ে সৈকত কর্তব্যরত পুলিশকর্মীকে চড় মারেন। সৈকতের পাল্টা অভিযোগ, ওই পুলিশকর্মী ঘুষ চেয়েছিলেন। তা নিয়ে মামলা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে পুলিশ সৈকতের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধাদানের ধারা (আইপিসি ৩৫৩) প্রয়োগ করে। পুলিশের এক কর্তা জানান, সৈকতকে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা নানা কারণে ভেস্তে যায়। সে কারণগুলি কী, জানতে চাইলে কোনও উত্তর দেননি তিনি।