গৌতম পালের (বাঁ দিকে) সঙ্গে মুকুল রায়। ছবি: তরুণ দেবনাথ।
জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভ ছিলই। সোমবার ফের সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল।
দলীয় কর্মী সমর্থকদের একাংশের দাবি মেনে উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদের তৃণমূলের দলনেতা গৌতম পালকে সহকারি সভাপতি পদে না বসানোয় কর্মী সমর্থকদের একাংশের ক্ষোভের মুখে পড়লেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তাঁর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন দলের কর্মী-সমর্থকদের একাংশ। দলের কর্মী সমর্থকদের একাংশের ক্ষোভ এ দিন স্বীকার করে নেন মুকুলবাবু। তাঁর কথায়, “সহকারি সভাধিপতি পদে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে দলের কিছু কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ওসব একটু হয়। যাঁদেরকে সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতি করা হয়েছে, তাঁরা সকলেই বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য। বিষয়টি দলের কর্মী সমর্থকেরা বুঝেছেন। সমস্যা মিটে গিয়েছে।” এ দিন জেলা পরিষদ থেকে বার হয়ে দৃশ্যত মুষড়ে পড়েন গৌতমবাবু।
সোমবার উত্তর দিনাজপুরের জেলা পরিষদের সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতি নির্বাচন হয়। সভাধিপতি পদে সদ্য সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া গোয়ালপোখরের সদস্য আলেমা নুরি চোপড়ার সিপিএমের সদস্য আসমাতারা বেগমকে ১৭-৭ ভোটে পরাজিত করে সভাধিপতি নির্বাচিত হন। সহকারি সভাধিপতি পদে ২৪ ঘন্টা আগে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া পূর্ণেন্দু দে বিদায়ী জেলা পরিষদের সহকারি সভাধিপতি প্রফুল্লকুমার দেবসিংহকে একই ব্যবধানে হারিয়েছেন।
দলীয় সূত্রের খবর, শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে যে সহকারি সভাধিপতি পদে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না, তা এ দিন সকালেই গৌতমবাবুকে স্পষ্ট করে দেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অমল আচার্য। সেকথা জানার পরেই মুষড়ে পড়েন গৌতমবাবু। দলের নেতা-কর্মীদের একাংশ-সহ গৌতমবাবুর অনুগামীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ১১টায় সভাধিপতি নির্বাচন শেষ হয়। বিদায়ী জেলা পরিষদের সভাধিপতি লাডলি চৌধুরী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলেন। সেই কথা মাথায় রেখে সদ্য সিপিএম ছেড়ে আসা আলেমা নুরিকে সভাধিপতি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দুপুর তিনটে থেকে সহকারি সভাধিপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ প্রশমন করতে দুপুর দু’টো নাগাদ গৌতমবাবুর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন মুকুলবাবু নিজে। তৃণমূল নেতাদের একাংশের দাবি, বৈঠকে মুকুলবাবু গৌতমবাবুকে ভবিষ্যতে দলের বড় দায়িত্ব দেওয়ার আশ্বাস দেন। বৈঠক থেকে বার হয়ে দু’জনকে একসঙ্গে হালকা মেজাজে দেখা যায়। কিন্তু বাঁধ ভাঙে বিকেল চারটে নাগাদ সহকারি সভাধিপতি পদে পূর্ণেন্দুবাবু নির্বাচিত হওয়ার পর। জেলা পরিষদ থেকে বার হয়ে একেবারেই মুষড়ে পড়েন গৌতমবাবু। বিষয়টি টের পেয়ে সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতির আগে তাঁকেই ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা জানান মুকুলবাবু-সহ জেলার নেতারা।
সেই সময় মুকুলবাবুকে কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, “আপনারা মনে রাখবেন সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতি-সহ তৃণমূলের ১৭ জন সদস্য এককভাবে জেলা পরিষদ দখল করল। গৌতমবাবু জেলা পরিষদের দলনেতা। তাঁর চেষ্টাতেই অনাস্থা এনে বামফ্রন্ট পরিচালিত জেলা পরিষদকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাই সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতি ছাড়াও গৌতমবাবুর মাধ্যমেই জেলা পরিষদের সার্বিক উন্নয়নের কাজ হবে।” আর সারাদিনের পর গৌতমবাবুর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “চোখের সামনেই তো সব দেখলেন। কী আর বলব! কিছু বলতে চাই না।”
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের ২৬টি আসনের মধ্যে ১৩টি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট। সিপিএম ১০টি, আরএসপি দু’টি ও ফরওয়ার্ড ব্লক একটি আসন পায়। কংগ্রেস ৮টি ও তৃণমূল ৫টি আসন দখল করে। গত ১২ সেপ্টেম্বর গৌতমবাবুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের ছ’জন ও কংগ্রেসের আট জন সদস্য তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিপিএমের সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন। রবিবার রাতেই কংগ্রেসের ছ’জন, সিপিএমের পাঁচ জন ও আরএসপির এক জেলা পরিষদ সদস্য লিখিতভাবে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার কথা জানান।
তৃণমূল সূত্রের খবর, গৌতমবাবু ইটাহারের ডক্টর মেঘনাদ সাহা কলেজের অধ্যক্ষা-সহ তিন শিক্ষক শিক্ষিকা ও এক শিক্ষাকর্মীকে নিগ্রহের ঘটনায় অভিযুক্ত। তাই সংবাদমাধ্যমে সমালোচনা রুখতে তাঁকে সহকারি সভাধিপতি পদে মনোনয়ন দেননি মুকুলবাবু। এ দিন সকালে মুকুলবাবু দলের সমস্ত জেলা নেতাকে সংবাদমাধ্যমে কোনও মন্তব্য না করার নির্দেশও দেন। দলের জেলার নেতা মোশারফ হোসেন, অসীম ঘোষ ও শেখর রায় পৃথকভাবে হলেও একই সুরে বলেন, “আমাদের কিছু বলা বারণ রয়েছে। তবে গৌতমবাবু সহকারি সভাধিপতি না হওয়ায় দলের কর্মী সমর্থকদের একাংশের মধ্যে সাময়িক ক্ষোভ ও হতাশা থাকলেও এখন সব মিটে গিয়েছে।”
জেলা পরিষদের ডান-বাম মিলিয়ে মোট ২৬ জন সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সামিল হলেও কংগ্রেসের দুই সদস্য নার্গিস খাতুন ও শেখ সামসুল ভোটাভুটিতে অংশ নেননি। তাঁরা বলেন, “আমরা তৃণমূলে যোগ দেব না বলেই ভোটাভুটিতে অংশ নিইনি।” আর বিদায়ী জেলা পরিষদের আরএসপির সহকারি সভাধিপতি প্রফুল্লকুমারবাবু বলেন, “মানুষের বার্তা দিতে তাই হার নিশ্চিত জেনেও বামফ্রন্টের সাত সদস্য সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতি পদে ভোটাভুটিতে অংশ নেন।”