ঝাড়পোঁচ হচ্ছে রেডিও। —নিজস্ব চিত্র।
আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা, তারপরেই পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা। মহালয়ার প্রভাতে আকাশবাণীর দৌলতে শোনা যাবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ। তাঁর কণ্ঠে শোনা যাবে দেবীর আগমনী বার্তা।
ইট বালি পাথর দিয়ে ঘেরা শহরে কাশ শিউলির গন্ধ আজ আর তেমন পাওয়া যায় না। কিন্তু ভোর চারটেয় এ বারও বেজে উঠেবে সেই পরিচিত কন্ঠ। যা ছাড়া এখনও বাঙালির দেবীপক্ষের আগমনী অসম্পূর্ণ। তবে জেনারেশন ওয়াই রেডিও-র থেকে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ্য ইন্টারনেটে। হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারে তাঁরা নিজেদের নিজস্ব বৃত্তের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন। এই যুগে রেডিও-ও আজ অনেকটাই পিছিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু প্রৌঢ়রা এখনও সেই প্রথা ভাঙেননি। সাড়া বছর রেডিওর খোঁজ না পড়লেও মহালয়ার দিন কয়েক আগে থেকেই তা ঝাড়া মোছা শুরু হয়। পুরোনো ব্যাটারি পাল্টে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে ঝালিয়েও নেন বেশ কয়েকবার। তাঁদের মতে, ইন্টারনেট বলুন আর সিডি ডিভিডি-ই বলুন, ভোরের আলো ফোটার আগে আকাশবাণীতে উদাক্ত কন্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনার দমবন্ধ করা উৎকণ্ঠা আর কোথাও নেই।
শহরের এক প্রবীণ নাগরিক দুলাল অধিকারী বললেন, ‘‘রেডিও চালানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছু শোনা যেত না। তাই ঘড়িতে চারটে বাজার আগে থেকেই রেডিও চালিয়ে দেওয়া হত। খানিকক্ষণ কোঁ শব্দের পরেই ঘোষণা হত ‘এখন আপনারা শুনছেন আকাশবাণী কলকাতা’। শঙ্খধ্বনির সঙ্গে শুরু হয়ে যেত আমাদের দুর্গা পূজা। তিনি জানান, ‘‘পাড়ার আর চার পাঁচটা বাড়ি থেকেও ভেসে আসত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মন্ত্রমুগ্ধ করা চণ্ডীপাঠ। কিন্তু এখন সে সব দিন আর কোথায়, আগের মতো সময় বেঁধে শহরাঞ্চলের এখন খুব কম বাড়িতেই শোনা যায় মহিষাসুরমর্দিনী। এবং মহালয়া শোনার জন্য রেডিওর বদলে ব্যবহার করা হয় মোবাইল ফোন অথবা এমপিথ্রি প্লেয়ার।’’ ফলে পুরোন ঐতিহ্য হারিয়ে যেতেই বসেছে বলে মনে করেন শহরের এই প্রবীণ ব্যাক্তি।
মহালায়ার সকালে কি করছেন, জিঙ্গাসা করা হলে, বছর পঁচিশের এক যুবক সৈকত দে বলেন, ‘‘মহালয়া মানেই তো পুজো চলেই এলো, তাই প্রতি বছরের মতো এবারও সকালে দিনের আলো ফুটলে মোটরবাইকে চেপে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাব আশেপাশে কোথাও একটা। আর রাতে ডিনারটা বাইরে কোনও রেস্টুরেন্টে, এই তো।’’
পাঁচ ছয় বছর আগে পর্যন্ত মহালায়ার সকালে বাড়ির রেডিওতে মহালয়া শোনা হত। কিন্তু বাজারে মহালয়ার সিডি বেড়িয়ে যাবার পর থেকে ভোরে না হলেও সকাল সাতটা আটটা নাগাদ বাড়ির ডিভিডি প্লেয়ারে মহালয়া বাজানো হয়।
একটি দোকানে এক সময় শুধু রেডিও-ই বিক্রি করা হত। গত চার পাঁচ বছরে তা বদলে গিয়েছে অনেকটাই। এখন সেখানে মেলে টিভি, ফ্রিজ সহ নানা ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্যসামগ্রী। সেই রেডিও বিক্রেতা রাজীব অগ্রবাল জানান, বেশ কিছু বছর আগে পর্যন্তও মানুষ রেডিও কিনতে আসত। সারা বছর তেমন বিক্রি না হলেও মহালয়াকে কেন্দ্র করে চার পাঁচটা রেডিও বিক্রি হত। কিন্তু গত দুই তিন বছরে তা একদমই কমে গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এখন মানুষ রেডিওর বদলে এমপিথ্রি প্লেয়ারে নিজেদের সময় মতো মহালয়া শুনতে পছন্দ করছেন।’’
কিন্তু উৎসবের অর্থ তো সবার সময়ে নিজের সময় মিশিয়ে নেওয়া। তারই যে সূচনা হয় মহালয়ায়।