স্মৃতি নিয়ে শিল্পের আশায় বেলাকোবা

জলপাইগুড়ি তথা বৈকুন্ঠপুরের রাজপরিবারের অন্যতম তালুক ছিল বেলাকোবা। রাজা প্রসন্নদেব রায়কত বেলাকোবায় চিনি তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তৈরি হয়েছিল আখ খেতের। পত্তন করেছিলেন চা বাগানেরও। তখন ১৯৪০ সাল। দেশভাগ হয়নি। বাংলাদেশের পচাগড়, বোদা, দেবীগঞ্জ তো বটেই অধুনা দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু শহরেও সেই কারখানা থেকে চিনি পৌঁছত। বেলাকোবার পাট ছিল বিখ্যাত। সোনালি রঙের পাট থেকে নানা দ্রব্য তৈরির ছোট-মাঝারি বেশ কয়েকটি কারখানা ছিল বেলাকোবা এলাকায়।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:২২
Share:

বেলাকোবা রেল স্টেশন। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

জলপাইগুড়ি তথা বৈকুন্ঠপুরের রাজপরিবারের অন্যতম তালুক ছিল বেলাকোবা। রাজা প্রসন্নদেব রায়কত বেলাকোবায় চিনি তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তৈরি হয়েছিল আখ খেতের। পত্তন করেছিলেন চা বাগানেরও। তখন ১৯৪০ সাল। দেশভাগ হয়নি। বাংলাদেশের পচাগড়, বোদা, দেবীগঞ্জ তো বটেই অধুনা দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু শহরেও সেই কারখানা থেকে চিনি পৌঁছত। বেলাকোবার পাট ছিল বিখ্যাত। সোনালি রঙের পাট থেকে নানা দ্রব্য তৈরির ছোট-মাঝারি বেশ কয়েকটি কারখানা ছিল বেলাকোবা এলাকায়। মালগাড়িতে বোঝাই হয়ে বেলাকোবার পাট পাড়ি দিত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাট কিনতে দিল্লি, গুজরাতের ব্যবসায়ীরাও বেলাকোবায় আসতেন। এখনও বেলাকোবার বেশ কয়েকটি পাটের গুদাম সেই সব স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে। পাটের ব্যবসার রমরমা থাকলেও, এলাকায় কোনও পাটজাত শিল্প তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। স্বাধীনতার পরে রাজ্য সরকারের কর্তা-ব্যক্তি বদলছে কিন্তু অবহেলার সেই ‘ট্র্যাডিশন’ বদলায়নি বলে অভিযোগ। একসময়ে যে বেলাকোবা থেকে টন টন পাট রেলগাড়িতে বোঝাই হয়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিত, এখন সেই বেলাকোবা স্টেশনে ‘রেক বুকিঙে’র সুবিধেটুকু পর্যন্ত নেই বলে অভিযোগ।

Advertisement

রাজার আমলের চিনি কল কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাজ শাসনের সময় বেলাকোবাতে বেশ কয়েকটি তাঁত কারখানাও তৈরি হয়েছিল। সেগুলিও ধুঁকে ধুঁকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নতুন কোনও চিনির কল অথবা কারখানাও স্বাধীনতার পরে বেলাকোবায় তৈরি হয়ননি। জলপাইগুড়ি জেলা তো বটেই উত্তরবঙ্গের মধ্যে রাজগঞ্জ ব্লক সব্জি এবং নানা ফল উৎপাদন, এবং গুণমানের জন্য পরিচিত। রাজগঞ্জ ব্লকের মধ্যে যোগাযোগ পরিকাঠামোয় এগিয়ে থাকা বেলাকোবাতে কোনও ফল বা কৃষি ভিত্তিক শিল্প স্থাপনের জন্যও কোনও উদ্যোগ হয়নি বলে বাসিন্দারা আক্ষেপ করেছেন।

আরও একটি সম্ভাবনার কথা শুনিয়েছেন বেলাকোবার প্রবীণেরা। কচ্ছপ নিলামের অন্যতম কেন্দ্র ছিল বেলাকোবা। এখানের পুকুরে কচ্ছপের ‘চাষ’ হতো। দেশের নানা রাজ্য থেকেও কচ্ছপ ট্রেনে চাপিয়ে পাঠানো হতো বেলাকোবা। বিভিন্ন রাজ্যের ব্যবসায়ীরা জড়ো হতেন এখানে। স্টেশন লাগোয়া এলাকায় হতো কচ্ছপ নিলাম। সত্তরের দশকের পরে কচ্ছপ কেনা-বেচায় নিষেধাজ্ঞা জারির পরে সেই নিলাম বন্ধ হয়ে যায়। যদিও, মাছ চাষের যে সম্ভাবনা এলাকায় ছিল, কচ্ছপের নিলাম সেই ঘটনা প্রমাণ করে বলে দাবি। পুকুর-বিল-জলাশয় অধ্যুষিত বেলাকোবাতে মাছ চাষের জন্য সুসংহত কোনও পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে বলে প্রশাসনের আধিকারিকরাও জানাতে পারেননি।

Advertisement

বর্তমানে পর্যটন শিল্পের প্রসারে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। তাতে এই জনপদ ব্রাত্য বলে অভিযোগ। বেলাকোবা শহরের মাত্র ২ কিলোমিটারের মধ্যে শিকারপুরের দেবী চৌধুরাণী মন্দির। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসে দেবী চৌধুরাণী এবং ভবানী পাঠককে পরিচয় করিয়েছেন। তার পর একাধিক সিনেমা, ধারাবাহিক, নানা তথ্য চিত্র জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে সাড়া ফেলেছে। দেবী চৌধুরাণীর মূল কর্মভূমি সেই শিকারপুরকে ঘিরে পর্যটনের পরিকল্পনাও হয়েছিল। কিন্তু সেগুলিও দিনের আলো দেখেনি বলে অভিযোগ। বেলাকোবা লাগোয়া আমবাড়ি এবং বোদাগঞ্জ এলাকাতেও পযর্টনের প্রসারের সুযোগ থাকলেও সেখানে সরকারি পর্যটন কেন্দ্র যেমন গড়ে ওঠেনি তেমনিই বেসরকারি উদ্যোগকেও অতিথি নিবাস গড়তে উৎসাহী করা হয়নি বলে অভিযোগ। এই এলাকাগুলি পর্যটন মানচিত্রে ঢুকে পড়লে বেলাকোবাই তার প্রাণকেন্দ্র হতো এবং ঘুরে দাঁড়াত এলাকার অর্থনীতি।

এলাকার তৃণমূল বিধায়ক খগেশ্বর রায়ের কথায়, “শিকারপুর-বোদাগঞ্জের সঙ্গে গজলডোবার পর্যটন কেন্দ্রের সঙ্গে জুড়ে নতুন একটি পর্যটন সার্কিট তৈরির চিন্তাভাবনা চলছে। পাশের আমবাড়ি শিল্পতালুককে নতুন করে গড়ার কাজ চলছে, তাহলে এর সুফল বেলাকোবাও পাবে। এবং বেলাকোবার চমচম নিয়ে একটা উদ্যোগ শুরু করার চেষ্টা করছি। চমচম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার আলোচনা হয়েছে।”

তবে আশ্বাসে বেশি ভরসা রাখতে পারেন না বেলাকোবার অনেকেই। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা দিলীপ দাসের কথায়, “শিল্পের রসদ আর যোগাযোগ পরিকাঠামো কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। কেউ উদ্যোগী হলেন না। এক সময়ে বেলাকোবা থেকে সেরা ফুটবল খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে। ফুটবল চর্চায় বেলাকোবার নামডাক ছড়িয়ে গিয়েছিল বহুদূর। এখনও কলকাতার দল বেলাকোবায় খেলতে আসে। তবু এখানে একটাও ফুটবল অ্যাকাডেমি তৈরি হল না।”

যে জনপদের পত্তন থেকে গড়ে ওঠার মধ্যে রাজকীয় আভিজাত্য ছিল, যে এলাকা শিক্ষা নাট্যচর্চায় স্বাধীনতার আগে থেকে সুনাম অর্জন করেছিল, স্বাধীতনতার ৭ দশক হতে চললেও সেই শহর এখনও পুরসভার স্বীকৃতি পায়নি। বাসিন্দাদের দাবি, এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।

প্রবীণদের স্মৃতিতেই শুধু ভেলু জোতদারের নাম রয়ে গিয়েছে। ভেলা নামেও তাঁর পরিচিতি ছিল। রাজাদের থেকে জমি নিয়ে নিজের জোত তৈরি করেছিলেন। সেই জায়গার নাম লোকমুখে ভেলা-কোপা ছড়িয়ে যায়। কোপা শব্দের অর্থ হল বাড়ি। অর্থাৎ ভেলার বাড়ি। ভেলা-কোপা। কালক্রমে তাই হয়ে যায় বেলাকোবা। ভেলুর পরেও আরেক জোতদারের কথা শোনা যায়। তিনি নিয়মিত ঘোড়া চরে এলাকায় টহল দিতেন। তাঁর পিছে পিছে চলত কচিকাঁচাদের লম্বা লাইন। সে অন্তত ২ দশক আগের কথা। তারপরে রাজাদের তৈরি করা চিনির কারখানা, করাত কল, আখ খেত, চা বাগানে কাজ করতে আশেপাশের অনেক জেলা থেকে বাসিন্দারা তখন কাজের খোঁজে বেলাকোবায় চলে আসছেন। শিল্পের সঙ্গে বিস্তার হয় শিক্ষারও।

সাফায়েদ আলি এবং সামের আলি দুই ভাইও রাজাদের থেকে কিছুটা জমি নিয়ে বেলাকোবায় আসেন। বেলাকোবার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দেবব্রত ভৌমিকের একটি প্রবন্ধ অনুযায়ী জানা যায় সামের আলি মৌলবী ছিলেন। তিনি বাড়িতেই একটি পাঠশালা খোলেন। নাম হয় পণ্ডিতের বাড়ি। পরবর্তীতে ১৯২০-২২ সালে নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩১ সালে তৈরি হয় আরও একটি স্কুল। এখন বেলাকোবায় তিনটি হাই স্কুল রয়েছে, যার মধ্যে একটি শুধু মেয়েদের। প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা অন্তত ১০টি। স্বাধীনতার আগে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকেও ছাত্র-ছাত্রীরা আসতেন বলে জানা গিয়েছে। শিক্ষক শিক্ষণের সরকারি কলেজও রয়েছে বেলাকোবায়। শিক্ষার সঙ্গে প্রসার হয় নাট্যচর্চারও। বেলাকোবার নাটকের দল নিয়মিত কলকাতায় গিয়ে নাটক করেছেন এমন বর্ণনাও পাওয়া যায়।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন