যা চাহিদা ছিল, দিল্লির বরাদ্দ এক ধাক্কায় নেমে গেল তার তিন ভাগের এক ভাগে। আর তাতেই গ্রামের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ার দশা পশ্চিমবঙ্গের! যার জেরে দিল্লিতে গিয়ে অনশনে বসার হুমকিও দিয়ে রাখছেন রাজ্যের মন্ত্রী!
গ্রামে পাকা রাস্তা বানাতে প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম সড়ক যোজনা খাতে চলতি অর্থবর্ষে কেন্দ্রের কাছে তিন হাজার কোটি টাকা চেয়েছিলেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সে জায়গায় কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী চৌধুরি বীরেন্দ্র সিংহ বরাদ্দ করেছেন সাকুল্যে ৯৫৪ কোটি, অর্থাৎ এক-তৃতীয়ংশেরও কম। যুক্তি হিসেবে কেন্দ্রের বক্তব্য: গত চার বছরের কাজের গুণমান, নির্মিত রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের হাল, প্রকল্প রূপায়ণকেন্দ্র (পিআইইউ) তৈরির খতিয়ান এবং বকেয়া প্রকল্পের সংখ্যার ভিত্তিতেই এই বরাদ্দ স্থির হয়েছে। বস্তুত গ্রাম-সড়ক রূপায়ণের ক্ষেত্রে গুজরাত, মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্র তো বটেই, ওড়িশা-মধ্যপ্রদেশের চেয়েও বাংলা যে পিছিয়ে, দিল্লির কর্তারা তা-ও জানাতে ভোলেননি।
এ দিকে ২০১৬ বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার কাঁচা বা মোরামের রাস্তা পাকা করার কাজ হাতে নিয়েছে পঞ্চায়েত দফতর। আধিকারিকেরা বলছেন, এখনই টাকা না-পেলে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অসম্ভব।
এমতাবস্থায় নবান্ন যারপরনাই ক্ষুব্ধ। সুব্রতবাবু ঠিক করেছেন, ১৮ এপ্রিল তিনি নিজে দিল্লি গিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। নবান্নের ইঙ্গিত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে ‘রাজ্যের প্রতি বঞ্চনা’র অভিযোগ তুলবেন। ‘‘হাতে না-পেরে কেন্দ্রীয় সরকার এখন ভাতে মারার চেষ্টা করছে। শুধু মমতার পিছনে সিবিআই লেলিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, রাজ্যের দশ কোটি মানুষকে উন্নয়ন থেকেও বঞ্চিত করছে।’— অভিযোগ করেছেন সুব্রতবাবু। পঞ্চায়েতমন্ত্রীর হুমকি, ‘‘কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমি রাজ্যের প্রাপ্য বরাদ্দ চাইব। পাওয়া গেলে ভাল। না-গেলে দরকারে মন্ত্রকের সামনে অনশনে বসব।’’
পঞ্চায়েত দফতর সূত্রের বলা হয়, মোদী-মমতা বৈঠকের পরে রাজ্যের আর্থিক দাবিদাওয়া পূরণের বিষয়ে খানিক ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গ্রামোন্নয়নের প্রায় সব প্রকল্পেই কেন্দ্র বরাদ্দ ছাঁটাই করছে। তুলে দেওয়া হয়েছে অনুন্নত এলাকা উন্নয়ন তহবিল (বিআরজিএফ) প্রকল্পও, যার আওতায় রাজ্যের ১১টি জেলা বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা অনুদান পেত।
এরই পাশাপাশি কোপ পড়েছে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম-সড়ক যোজনার বরাদ্দে। পশ্চিমবঙ্গে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক সত্যব্রত চক্রবর্তী জানান, গত অর্থবর্ষে (২০১৪-১৫) কেন্দ্র ১১৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। এ দিকে ২০১৫-র ৩১ মার্চ পর্যন্ত ১৪৫১ কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। কাজ চালু রাখতে রক্ষণাবেক্ষণ-তহবিল থেকে সাড়ে চারশো কোটি টাকা ধার করতে হয়েছে। ‘‘ঠিকাদারদের ৬০ কোটি টাকার বিল বাকি। অথচ শুনছি, চলতি বছরে ৯৫৪ কোটির বেশি মিলবে না!’’— বিস্মিত সত্যব্রতবাবু।
নবান্নের একাংশ জানিয়েছেন, দেড় বছরের মধ্যে ৪ হাজার কিলোমিটার রাস্তা বানিয়ে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্যের। যে জন্য এ বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘পক্ষপাতমূলক’ কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত পুরো উদ্যোগে জল ঢেলে দিতে চলেছে বলে এই মহলের আক্ষেপ। অন্য দিকে কেন্দ্রীয় কর্তাদের একাংশ বলছেন, যেখানে বকেয়া প্রকল্পের সংখ্যা কম, এ বার সেখানে কম টাকা দেওয়া হয়েছে। যেখানে ঢের কাজ বাকি, সেই সব রাজ্যে বরাদ্দ হয়েছে ঢেলে।
‘‘আর সেই নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ যথেষ্ট টাকা পেয়েছে, কারণ সেখানে বিস্তর কাজ বকেয়া।’’— বলছেন মন্ত্রকের এক সূত্র। দিল্লির হিসেবে, চলতি অর্থবর্ষে গ্রাম-সড়ক যোজনায় ২৯টি রাজ্যের জন্য মোট ৯৮৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি— ২২৩৪ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে বিহারকে, কারণ বিহারে কাজ তেমন হয়নি। তার পরেই পশ্চিমবঙ্গ— ৯৫৪ কোটি। ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশ যথাক্রমে ৮৯৩ ও ৭৯৪ কোটি। মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘গুজরাত পাচ্ছে ৩০৩ কোটি, মহারাষ্ট্র ২৯১ কোটি। অন্ধ্রকে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ১৬৩ কোটি টাকা। ওই রাজ্যগুলোয় কাজ অনেক এগিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ পারেনি। আর তাই টাকাও বেশি পেয়েছে। বঞ্চনার প্রশ্ন ওঠে না।’’
কোন কোন মাপকাঠিতে বরাদ্দ স্থির হয়েছে, রাজ্যকে তা বিস্তারিত জানিয়েওছে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। ‘বকেয়া কাজের বহর ছাড়াও রাজ্যের হাতে পড়ে থাকা টাকার পরিমাণ, রাস্তার গুণমান, রক্ষণাবেক্ষণের মান ইত্যাদির ভিত্তিতে বরাদ্দ নির্ধারিত হয়েছে।’— রাজ্যের পঞ্চায়েত-সচিব সৌরভ দাসকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন মন্ত্রকের গ্রামীণ সংযোগ বিভাগের অধিকর্তা ওয়াইএস দ্বিবেদী। অধিকর্তা এ-ও লিখেছেন, ‘এটাই শেষ নয়। পরবর্তীকালে কাজ ভাল করলে বরাদ্দ বাড়বে। কাজ করতে না-পারলে কমিয়ে দিতেও পিছপা হবে না কেন্দ্র।’