কসবার পুর-ক্লিনিক থেকে দেওয়া সেই চিরকুট। —নিজস্ব চিত্র।
টানা এগারো দিন জ্বরে ভুগছিল কসবার বাসিন্দা সাড়ে তিন বছরের একটি শিশু। সাত দিনের মাথায় কলকাতা পুরসভার ক্লিনিকে রক্ত পরীক্ষা করে জানানো হল, ডেঙ্গি হয়নি। ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট কোথায়? ক্লিনিকের কর্মীরা বলেন, ‘‘প্লেটলেট ঠিক আছে। আমরা সেটাই দেখে নিয়েছি।’’ ডেঙ্গি পরীক্ষা হয়নি? উত্তর এল, ‘‘ওটা দরকার নেই।’’
শুধুমাত্র প্লেটলেট কাউন্ট পরীক্ষা করেই কি তবে ডেঙ্গি হয়েছে না হয়নি, বলে দিচ্ছে পুরসভা? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা কিন্তু এই প্রবণতাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করছেন। তাঁদের মতে, সব ক্ষেত্রে প্লেটলেটের পরিমাণ দিয়ে মোটেই ডেঙ্গির বিচার করা যায় না। অথচ পুরসভার একাধিক ক্লিনিকে সেটাই হয়ে চলেছে বলে অভিযোগ। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, নিয়ম মেনে পরীক্ষা না হওয়াতেই পুরসভার হিসেবে শহরে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৬২৫! পরীক্ষা না হওয়ায় বহু জ্বরই ‘অজানা জ্বর’ খাতায় হয়ে থেকে যাচ্ছে!
আরও পড়ুন: পাভলভ থেকে ঘরে বাংলাদেশের তরুণী
প্রশ্ন উঠেছে, বহু বেসরকারি ল্যাব যেমন রিপোর্টে ডেঙ্গি লিখতে ভয় পাচ্ছে, সেই একই ভয় কি তবে কাজ করছে পুরক্লিনিকেও? সেই কারণেই কি শুধুমাত্র ম্যালেরিয়া পরীক্ষা এবং প্লেটলেটের পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে? কলকাতায় পুরসভার ১৪৪টি ক্লিনিকের মধ্যে ১৫টি ক্লিনিকে ডেঙ্গি নির্ণয় হয় বলে পুর-কর্তৃপক্ষের দাবি। কীসের ভিত্তিতে ডেঙ্গি নির্ণয় হয়? প্রশ্ন করলে পুরসভার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মনিরুল ইসলাম মোল্লা নিজেই জানালেন, প্লেটলেট পর্যাপ্ত থাকলে ধরে নেওয়া হয় ডেঙ্গি নেই।
কসবার শিশুটিকেও তাই-ই বলা হয়েছিল। চিরকুটে লিখে দেওয়া হয়েছিল, প্যারাসিটামল খাওয়ালেই জ্বর কমে যাবে। কিন্তু পরের কয়েক দিনেও জ্বর না কমায় শেষ পর্যন্ত একটি বেসরকারি ল্যাবে রক্ত পরীক্ষা করানো হয় শিশুটির। সেখানে এনএস১ এলাইজা পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় এ দিন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বাড়ির লোকেরা জানিয়েছেন, টানা ১০৩-১০৪ জ্বর চলছে শিশুটির। সঙ্গে মাথায় ব্যথা, বমি। গায়ে র্যাশ বেরিয়েছে। সেই অবস্থাতেও তার ডেঙ্গি পরীক্ষা করা হল না কেন? সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর সাত নম্বর বরোর ওই ক্লিনিকের কর্মীরা দিতে পারেননি। শনিবার যোগাযোগ করা হলে তাঁরা শুধু বলেছেন, জ্বর নিয়ে যত জন আসছেন, তাঁদের সকলেরই তো আর ডেঙ্গি পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই প্লেটলেট দেখেই আঁচ পাওয়ার চেষ্টা চলছে। এই শিশুটির প্লে়টলেট এক লক্ষের বেশি ছিল।
যদিও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এক বার প্লেটলেট পরীক্ষা করে কিছু বোঝা যায় না। প্লেটলেট পর্যাপ্ত থাকলেও অন্যান্য মাপকাঠি খারাপ থাকতে পারে। তা ছাড়া, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জ্বর ছাড়ার পরে প্লেটলেট কমে। এবং বহু ক্ষেত্রে সেটা এক ধাক্কায় এমন কমে যে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। ঠিক যেমনটি ঘটেছে বিজয়গড়ের আবির্ভাব মজুমদারের ক্ষেত্রে। শনিবারই মারা গিয়েছে দশ বছরের ছেলেটি। সোমবার এক লাখের বেশি প্লেটলেট নিয়েই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সে। মঙ্গলবার এক লাফে তা ৩৩ হাজারে নেমে যায়।
মনিরুল সাহেব নিজেও স্বীকার করছেন, ‘‘এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। এখন প্লেটলেটের ওপরে সত্যিই আর সব কিছু নির্ভর করে না।’’ তা হলে কি জেনেশুনেই মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।