ঘরে ফেরা: কাজী জেসমিন।
আড়াই বছর ধরে যে শহর তাঁকে আপন করে নিয়েছে, পরম মমতায় তাঁর শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলেছে, ভাইফোঁটার সকালে চোখে জল নিয়ে সেই শহর ছাড়লেন কাজী জেসমিন। কলকাতার হাসপাতাল থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছলেন সাতক্ষীরায় তাঁর নিজের বাড়িতে। জেসমিনের মা কলকাতায় মেয়ের আশ্রয়দাতাদের ফোন করে শুধু যে নিজের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তা-ই নয়, জানিয়েছেন ভালবাসার এই সুতোয় তিনি বাকি জীবনের জন্য বাঁধা পড়েছেন এই শহরের সঙ্গে।
বেশ কয়েক বছর আগে মানসিক সমস্যা ধরা পড়েছিল বাংলাদেশের সাতক্ষীরার জেসমিনের। আড়াই বছর আগে এক দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। আর ফেরেননি। বাড়ির লোকজনেরা বহু খোঁজখবর করেও তাঁর সন্ধান পাননি। মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশা এক প্রকার ছাড়তেই বসেছিলেন পরিবারের লোকেরা। অন্য দিকে, জেসমিন কোনও ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছিলেন এ দেশে। তাঁর কাছে পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই ছিল না। উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর থানার পুলিশের মাধ্যমে তাঁর ঠাঁই হয় কলকাতার পাভলভ মানসিক হাসপাতালে। গোড়ায় সেখানে নিজের নাম-পরিচয় কিছুই বলতে পারতেন না ৩৩ বছরের ওই তরুণী। টানা চিকিৎসায় ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তাঁর মনে পড়ে যায় সব কিছু। মনে পড়ে সাতক্ষীরার বাড়ির কথা, মা-ভাইদের কথা, নিজের একমাত্র মেয়ের কথা।
আরও পড়ুন: পরীক্ষাতেই গলদ, প্লেটলেট গুনেই ক্ষান্ত পুর-ক্লিনিক
এর পরেই পাভলভ হাসপাতালের তরফে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে। বাংলাদেশ দূতাবাস জেসমিনের দেওয়া ঠিকানার সূত্র ধরে যোগাযোগ করে বাড়ির লোকের সঙ্গে। এর পরে দুই দেশের যোগাযোগের মাধ্যমে তৈরি হয় জেসমিনকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া। জানা যায়, বাড়িতে জেসমিনের মা এবং দাদা রয়েছেন। বিবাহিতা হলেও স্বামীর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই তাঁর। তবে আট বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। জেসমিনের দাদা শনিবার সীমান্ত থেকে বোনকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। হাসপাতালের তরফে মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা তাঁকে ফিরিয়ে দিতে এসেছিলেন। তাঁদের তরফে অনিন্দিতা চক্রবর্তী জানান, যেহেতু জেসমিনের পাসপোর্ট নেই, তাই দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে ‘ট্রাভেল পারমিট’ পাঠানো হয়। তাঁকে একটি অস্থায়ী নম্বর দেওয়া হয়। জানানো হয়, ওই নম্বর পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে যে কোনও সময়ে তিনি বাংলাদেশ ফিরতে পারবেন। দিল্লির ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসও সব ধরনের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। অনিন্দিতা বলেন, ‘‘জেসমিনের বাড়িতে আমরা যখন যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম, তখন ওঁরা অনুরোধ করেছিলেন যে ভাবে হোক পেট্রাপোল সীমান্তে যদি আমরা ওকে পৌঁছে দিতে পারি, তা হলে ওঁরা নিয়ে যাবেন। সেই অনুযায়ীই ব্যবস্থা হয়।’’
পেট্রাপোল সীমান্তে দাদার সঙ্গে।
কেমন লাগছে মেয়েকে কাছে পেয়ে? ফোনে জেসমিনের মা জানান, এখনও সবটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘মেয়ের মানসিক সমস্যা ছিল বলে অনেকেই মনে করেছিল আমরাই বোধহয় ওকে দূরে কোথাও সরিয়ে দিয়েছি। ও ফিরে এসে সেই সব অভিযোগ থেকেও আমাদের মুক্তি দিল। এ বার থেকে ওকে আরও চোখে চোখে রাখব। যাতে আর হারিয়ে না যায়।’’
কী বলছেন জেসমিন? তাঁর কথায়, ‘‘খুব ভাল লাগছে। যাঁদের জন্য আবার নিজের ঘরে ফিরতে পারলাম, তাঁদের কথা সারা জীবন মনে রাখব।’’
বছর খানেক আগে এই পাভলভ হাসলপাতাল থেকেই বাংলাদেশের আর এক রোগীকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সে বার অবশ্য পুলিশের ভ্যানে চাপিয়ে তাঁকে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। জেসমিন অবশ্য পুলিশের গাড়িতে নয়, হাসপাতাল থেকে সীমান্তে পৌঁছলেন ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গাড়িতেই। সংগঠনের তরফে শুক্লা দাসবড়ুয়া বলেন, ‘‘শুধুমাত্র মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন বলেই কাউকে অপরাধীর মতো পুলিশের ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোরতর বিরোধী আমরা। জেসমিনের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। এ থেকেই বোঝা যায়, মনোরোগীদের নিয়ে সামাজিক ধারণা আগের তুলনায় সামান্য হলেও বদলাচ্ছে। আশার কথা এটাই।’’
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy