পাচারে বরাদ্দ একটু বাড়ান স্যার!

বাজেট পেশ করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই অর্থমন্ত্রী বলছেন, কন্যাশ্রী প্রকল্পে এ বার থেকে এক জন কন্যাসন্তানকে ২৫ হাজারের বদলে এক লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০২:৩৬
Share:

বিধানসভা চত্বরে বিরোধীদের নকল অধিবেশন। ছবি: প্রদীপ আদক।

বাজেট পেশ করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই অর্থমন্ত্রী বলছেন, কন্যাশ্রী প্রকল্পে এ বার থেকে এক জন কন্যাসন্তানকে ২৫ হাজারের বদলে এক লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। এর জন্য রাজ্যের ভাঁড়ারে টান পড়লে সারদার মতো সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া টাকা থেকে সামলে দেওয়া হবে!

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই শাসক দলের বিধায়ক দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বলছেন, ‘‘অর্থমন্ত্রী সরকারের নাক কেটে দিচ্ছেন। তাঁকে বরখাস্ত করুন। ওখানে আমাকে বসান!’’ শাসক বেঞ্চ থেকেই দাবি উঠছে, এই বাজেট প্রত্যাহার করে নতুন বাজেট আনা হোক।

শাসক ও বিরোধীর হট্টগোল সামলাতে গিয়ে স্পিকার বারবার তাঁর ডান দিকে মন্ত্রীদের আসনের দিকে তাকাচ্ছেন। বিরোধীরা প্রশ্ন করলে স্পিকার মেনে নিচ্ছেন, ‘‘কী করব! আমার ঘাড় বাঁ দিকে ঘোরে না!’’ আর পরিষদীয় মন্ত্রী বিরোধীদের ধমকে সরাসরিই বলছেন, ‘‘স্পিকার আমার পুতুল! যা বলার, আমিই বলব!’’

Advertisement

গরু ও কয়লা পাচারের জন্য আস্ত দু’টি দফতর তৈরি হয়েছে রাজ্যে! দুই দফতরের মন্ত্রীরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিধানসভায়। অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশ শেষ হওয়া মাত্র কয়লা পাচার মন্ত্রী স্পিকারের উদ্দেশে গলা তুলছেন, ‘‘স্যার, পাচার থেকে টাকা তুলে ভাইপোকে নজরানা দিয়ে তার পরে বিধায়ক কিনতে বেশি খরচা করা সম্ভব হচ্ছে না। দফতরের বরাদ্দটা বাড়াতে বলুন স্যার!’’ আঁতকে উঠে স্পিকার নির্দেশ দিচ্ছেন, এ সব কথা বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিতে হবে। যা শুনে আবার বিরোধী বিধায়কেরা হইহই করছেন, ‘‘শাসক বেঞ্চের বক্তব্য বাদ? আপনার চাকরি থাকবে না স্যার!’’

বিবরণ শুনে কেউ কেউ ভাবতে পারেন সিনেমা বুঝি! আসলে সিনেমা নয়। সিনেমার মতো! ঘটছে বাস্তবেই। তবে বিধানসভার ভিতরে নয়। অধিবেশন কক্ষের বাইরে বিধানসভার পোর্টিকোয়। যেখানে শুক্রবার নকল অধিবেশন বসিয়ে রাজ্য সরকারি বাজেটের পাল্টা বিকল্প বাজেট পেশ করল বিরোধীরা। যে বাজেটে অর্থমন্ত্রীর জবানিতে কৌশলে সেই সব কথাই বলিয়ে নেওয়া হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নীতির সমালোচনায় যেগুলো বলে থাকেন বিরোধী নেতারা। কৌতুক, ব্যঙ্গ আর পরিহাসের তীক্ষ্ণ তিরে সরকারকে বেঁধার পাশাপাশিই তৃণমূল সরকারের নীতির কিছু পরিবর্তনও ঘটিয়ে দেওয়া হল বাজেটে! কংগ্রেস ও বাম পরিষদীয় দলের নেতাদের কথায়, ‘‘এটা তো প্রতীকী বাজেট। আমরা এমন কিছু এখানে বলতে চেয়েছি, যা সরকার মেনে নিলে রাজ্যটার ভাল হতো।’’

উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, বিকল্প বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছেন— সরকার অধিগ্রহণ না করলে জমি মাফিয়াদের শোষণে কৃষকেরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন। সৃষ্টি হয় ভাঙড়ের মতো সমস্যা। শিল্পায়নের স্বার্থে ২০১৩ সালে ইউপিএ সরকারের করা কেন্দ্রীয় জমি অধিগ্রহণ আইনে সরকারের জমি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বলাই বাহুল্য, তৃণমূল সরকার জমি অধিগ্রহণের বদলে শিল্পপতিদের জমি কিনে নেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী।

রীতিমতো মাথা খাটিয়ে বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী এবং প্রাক্তন আইএএস তথা কংগ্রেস বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা আলোচনা করে তৈরি করেছিলেন বিকল্প বাজেট। নকল অধিবেশনে সুখবিলাসবাবুই ছিলেন অর্থমন্ত্রীর আসনে। আর সুজনবাবু নাম ভূমিকায়। বাজেটের মাঝখানে সুখবিলাস ও সুজনকে অবশ্য বেশ কয়েক বার তরজায় জড়াতে দেখা গিয়েছে! মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ছিলেন সিপিএম বিধায়ক জাহানারা খান। মাঝেমধ্যে রাগত স্বরে যিনি বিরোধী বেঞ্চের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘‘চুপ করে থাকুন! জেলে পুরে দেব!’’ তাঁর পাশে, চেহারায় বিপুল বৈপরীত্য নিয়েও পরিষদীয় মন্ত্রী কংগ্রেসের মনোজ চক্রবর্তী! আরএসপি-র প্রবীণ বিধায়ক বিশ্বনাথ চৌধুরীর দায়িত্ব ছিল স্পিকার হিসাবে অধিবেশন পরিচালনা করা। বেল বাজিয়ে, হাতুড়ি ঠুকে উত্তপ্ত সভা নিয়ন্ত্রণে বেশ বেগ পেতে হল তাঁকে!

গরু পাচার আর কয়লা পাচার মন্ত্রীর ভূমিকায় কংগ্রেসের দুই বিধায়ক আখরুজ্জামান ও সুদীপ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বেশি আকর্ষণের কেন্দ্রে। তাঁদের দফতরের অভিনবত্বের জন্যই! বস্তুত, পাচার নিয়ে তরজা এমনই উচ্চগ্রামে পৌঁছেছিল, মন্ত্রীর পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে শাসক দলের এক বিধায়কের এমন মন্তব্যও শোনা গেল— ‘‘চারটে গরু চুরি করেছে বলেই কি গরু চোর হয়ে গেল?’’ আসল বিধানসভায় যে কথা তাঁদের আকছার শুনতে হয়, নকল সভায় সেই অস্ত্রই উল্টো দিকে প্রয়োগ করলেন সিপিএমের তন্ময় ভট্টাচার্য। শাসক দলের বিধায়কের ভূমিকায় তিনি চেঁচিয়ে বলছিলেন বিরোধীদের, ‘‘৩৪ বছর অনেক বলেছেন। এখন চুপ করুন!’’ দর্শকের ভূমিকায় স্মিতহাস্যে তখন তাঁর সহধর্মিণীও।

শাসক দল অবশ্য এমন ব্যঙ্গ-বাণে অবিচলিতই। সত্যিকারের পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সাফ বলে দিয়েছেন, ‘‘মিডিয়ায় ছবি তোলানোর জন্য যত্ত সব কাণ্ড!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন