সিঙ্গুরের ক্ষত উস্কে নয়া গাড়ি সানন্দ থেকে

সানন্দের কারখানায় টাটাদের তৈরি যে গাড়ির চাকা বুধবার গড়াতে শুরু করল, বিজ্ঞাপনে তার চালক লিওনেল মেসি! চালকের আসনে যাত্রীর অপেক্ষায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকা অবশ্য অভ্যেস হয়ে গিয়েছে সিঙ্গুরেরও।

Advertisement

দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৬
Share:

সানন্দের কারখানায় টাটাদের তৈরি যে গাড়ির চাকা বুধবার গড়াতে শুরু করল, বিজ্ঞাপনে তার চালক লিওনেল মেসি! চালকের আসনে যাত্রীর অপেক্ষায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকা অবশ্য অভ্যেস হয়ে গিয়েছে সিঙ্গুরেরও। জঙ্গি জমি আন্দোলনের জেরে প্রস্তাবিত ন্যানো কারখানার গেটে তালা ঝোলার পরে নিয়মিত যাত্রী পাওয়াই দায় হয়েছে ভ্যানোর। সানন্দে তৈরি টাটা মোটরসের নতুন গাড়ি ‘টিয়াগো’ যেখানে নতুন লগ্নি আর প্রায় এক হাজার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে, সেখানে সব খুইয়ে ফের এক ভোটের প্রহর গুনছে সিঙ্গুর।

Advertisement

হপ্তা তিনেক পরেই ভোট সিঙ্গুরে। যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমি আন্দোলনের জেরে টাটাদের প্রস্তাবিত গাড়ি কারখানায় তালা পড়েছিল বছর আটেক আগে। সেই চারশো বিঘা ৫০ বছরেও ফেরত পাওয়া যাবে কি না, মুখ্যমন্ত্রী জানেন না। কাজেই চাষ-আবাদের প্রশ্ন নেই। কারখানা হয়নি। তাই মাঠে মারা গিয়েছে চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন। তাই সানন্দ যখন আজ যাত্রিগাড়ি ব্যবসায় টাটাদের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন সেই একই অন্ধকারে আটকে রয়েছে সিঙ্গুর।

বাজারে ন্যানো কতটা সফল, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর এ দিন সবে দেশের বাজারে পা রেখেছে টিয়াগো। যাত্রিগাড়ির বাজারে পায়ের তলায় হারানো মাটি ফিরে পেতে যার উপর বড়সড় বাজি ধরছে টাটারা। মাসে গড়ে মাত্র আড়াই হাজারের মতো ন্যানো বিক্রি নিয়ে সংস্থার দাবি, একটি গাড়ি দিয়ে কারখানার অবস্থা যাচাই করা অর্থহীন। তার উপর অনেকে মনে করেন, প্রচার ও বিপণনে ফাঁক থাকায় ন্যানোর বিক্রি যদি প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েও থাকে, তাতে ক্ষতি টাটাদের। সানন্দের ফায়দা তাতে আটকায়নি। কারণ, ওই গাড়ি তৈরির জন্য বিনিয়োগ সেখানে গিয়েছে। হয়েছে কর্মসংস্থান। এখন তার উপর টিয়াগোর মতো নতুন গাড়িও ওই কারখানা থেকেই তৈরি করছে টাটারা। বছর চারেক আগে খোলনলচে বদলে একের পর এক নতুন ধরনের গাড়ি বাজারে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল টাটা মোটরস। জানিয়েছিল, ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর দু’টি করে গাড়ি বাজারে আনবে তারা। তারই প্রথম ‘কিস্তি’ টিয়াগো। এ দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে যা মুখ দেখিয়েছে মুম্বইয়ে। আবার এ বছরই বাজারে আসার কথা টাটাদের সেডান গাড়ি—‘কাইট৫’। তা-ও তৈরি হওয়ার কথা সানন্দে।

Advertisement

নতুন গাড়ি মানে নতুন লগ্নি। সঙ্গে কাজের সুযোগও। টাটারা চলে না-গেলে যে এই সবও তাদের ঝুলিতে আসত, আজ হয়তো ভোটের মুখে তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুঝছে সিঙ্গুর।

সংস্থাও জানাচ্ছে, নতুন ধরনের গাড়ি তৈরির জন্য আলাদা করে টাকা ঢেলেছে তারা। শুধু সানন্দে লগ্নির অঙ্ক স্পষ্ট না করলেও টাটা মোটরস জানিয়েছে, গবেষণা ও আনুষঙ্গিক কাজের জন্য বছরে গড়ে ৩,৫০০-৪,০০০ কোটি টাকা ঢালবে তারা। উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্রের চাকনে নতুন গাড়ি তৈরিতে ১,২০০ কোটি ঢেলেছে মহীন্দ্রা গোষ্ঠী। কেউ-কেউ মনে করেন, তা থেকে সানন্দে বিনিয়োগের একটা আঁচ হয়তো পাওয়া সম্ভব।

টাটা মোটরস জানিয়েছে, সানন্দে তাদের কর্মী সংখ্যা ২,৬০০। তারা স্পষ্ট না করলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, এর মধ্যে শুধু টিয়াগো তৈরির জন্যই নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে হাজার খানেক। সেই সঙ্গে সংলগ্ন এলাকায় সহযোগী যন্ত্রাংশ শিল্পেও আরও কয়েক হাজার কর্মসংস্থান হবে বলে দাবি সেই শিল্পের এক কর্তারই।

চটকে যাওয়া ন্যানো কারখানার প্রভাব সিঙ্গুরের ভোট-বাজারে টাটকা। তাই সেই ক্ষতে মলম দিতে ‘অনিচ্ছুক’দের মাসে দু’হাজার টাকা ভাতা আর দু’টাকা কিলোর চাল দিতে হয় রাজ্যকে। আবার সম্ভবত কারখানা হারানোর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতেই ব্যালট-যুদ্ধের আগে সেখানে প্রচারে বাম প্রার্থীর বাহন ছিল ন্যানো।

প্রায় সকলেই বলেন রাজ্যে পালাবদলের ইতিহাসে সিঙ্গুর অন্যতম মাইলফলক। অথচ ভোটের মুখে সেখানকার মানুষের হতাশা আর দীর্ঘশ্বাসই বিরোধীদের রাজনৈতিক প্রচারের ইস্যু। তাকে নস্যাৎ করে ভোট-বাক্স ভরা চ্যালেঞ্জ শাসক দলেরও। এ রাজ্যের শিল্পমহলের অনেকের আক্ষেপ, সানন্দে টাটাদের পা পড়া থেকেই গাড়ি শিল্পে গুজরাতের কেউ-কেটা হওয়ার শুরু। আর সিঙ্গুর হারিয়ে এ রাজ্যে শুরু শিল্পের শ্মশানযাত্রার। ভোটের মুখে তাই সানন্দের দরজা খুলে বেরোনো টিয়াগো সেই যন্ত্রণাই ফের উস্কে দিল বলে মনে করছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন