Partha Chatterjee

বন্দিদশায় ১০০ দিন কেটে গেল প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থের, এমন ‘সেঞ্চুরি’ তিনি কোনও দিন চাননি!

একদা রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে ছিলেন। সংগঠন, শাসনের জোড়া দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু দলের ভাল-মন্দের হিসাব কষা পার্থ ভাবতে পারেননি তাঁকে এই শতকিয়াও গুনতে হবে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২২ ১৩:২৮
Share:

১০০ দিনের বন্দিদশা জুড়ল তাঁর জীবনে। না-চাইতেও সেঞ্চুরি পেলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই।

১০০-র সঙ্গে কি পূর্ণতার একটা যোগ আছে? অঙ্কে ১০০-য় ১০০, ১০০ শতাংশ, ক্রিকেট মাঠে ব্যাটারের ১০০ ইত্যাদি। মঙ্গলবার তেমনই একটি ১০০ ছুঁলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। গত ২৩ জুলাই রাত থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাব করলে বন্দিদশায় ঠিক ১০০টি দিন কাটল তাঁর। যদিও পার্থের এই ১০০-এ ‘সেঞ্চুরির’ গরিমা নেই। পূর্ণতা? তা বোধ হয় কিছুটা আছে। এই ১০০ দিনে হারানোর ঝুলিটি প্রায় পূর্ণ করে ফেলেছেন তিনি।

Advertisement

একদা রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে ছিলেন। সংগঠন, শাসনের জোড়া দায়িত্ব সামলেছেন। বহু পূর্ণতার সাক্ষীও থেকেছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু দু’হাতে দলের ভাল-মন্দ এবং আরও অনেক পূর্ণতা-অপূর্ণতার হিসাব কষা পার্থ ভাবতে পারেননি তাঁকে এই শতকিয়াও গুনতে হবে। তবে গুনেছেন যে, তার প্রমাণ বন্দিদশার ৯৯তম দিনে আদালতের সামনে তাঁর বয়ান। ইডির মামলায় জামিনের দরবার করে পার্থ সোমবার বলেছিলেন, ‘‘এখানে ১০০টি দিন কাটতে চলল আমার। কিছুই পাওয়া যায়নি।’’

পার্থ অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তকারীদের হাতে প্রমাণ পাওয়ার কথাই বলতে চেয়েছিলেন। তবে আক্ষরিক অর্থে গত ১০০ দিনে তিনিও কিছু পাননি। যেখানে দলীয় পদে তাঁর থেকে অনেক নিচু স্তরে থাকা তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল গ্রেফতার হওয়ার পরও দলীয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থন পেয়েছেন, সেখানে পার্থের কপালে সেটুকুও জোটেনি। বরং গ্রেফতার হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে সাসপেন্ড করা হয়েছে পার্থকে। তাঁরই জন্য তৈরি হওয়া দলের ‘মহাসচিব’ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপসারণ করা হয়েছে অন্যান্য প্রশাসনিক পদ থেকেও। কেড়ে নেওয়া হয়েছে মন্ত্রিত্ব। ক্ষমতা-প্রভাবের শেষ চিহ্নটুকু মুছে গিয়েছে পার্থের হাত থেকে।

Advertisement

রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থের দিকে তখন থেকেই অভিযোগের আঙুল উঠতে শুরু করে। কারণ, যে সময়কালের দুর্নীতির অভিযোগ, তখন তিনিই ছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষা বিষয়ক সরকারি সমস্ত কার্যকলাপের মূল নিয়ন্ত্রক। পার্থ যতই বলুন তাঁর আজ্ঞাবহরাই দায়িত্ব সামলাতেন, আদালত বা তদন্তকারীদের কাছে সেই সব যুক্তি ধোপে টেকেনি। স্বাভাবিক ভাবেই দায় গিয়ে পড়ে তাঁর ঘাড়েই। ইডি-সিবিআই তদন্তে নামে। পার্থের বাড়ি থেকে পাওয়া যায় অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের নামে দলিল। আর তার সূত্র ধরে অর্পিতার দু’টি বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মোট ৪৯ কোটি ৮০ লক্ষ নগদ টাকা উদ্ধার করে ইডি। গ্রেফতার হন পার্থ। গ্রেফতার হন অর্পিতাও। ইডি জানায় এই অর্পিতা পার্থের ‘ঘনিষ্ঠ’। অর্পিতার নামে ৩১টি বিমার দলিলে প্রাপক হিসাবেও নাম পাওয়া যায় পার্থের। একদা আড়ালে থাকা শিক্ষামন্ত্রীর অন্য জীবন হঠাৎ হাট হয়ে খুলে যায় আমজনতার সামনে।

প্রাক্তন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাঁটাছেড়া চলছিলই। তা নতুন মাত্রা পায় তদন্তকারীরা পার্থের মেয়ে এবং জামাইকেও এই দুর্নীতির তদন্তে জড়িয়ে ফেলায়। পার্থের বিদেশবাসী জামাইকে তাঁরা ডেকে পাঠান জেরা করার জন্য। বাবার ‘ভুল’-এ টানাটানি শুরু হয় মেয়ের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও।

একদা তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। পার্থের মেজাজ যে কতখানি, তা সোমবার ক্ষণিকের জন্য বোঝাও গিয়েছিল। শুনানির জন্য আদলতে ঢোকার আগে যখন সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ, তা সত্যি কিনা, তখন প্রশ্ন শুনেই সাংবাদিকদের পাল্টা ধমক দিয়েছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী। আঙুল তুলে বলেছিলেন ‘‘চুপ করুন!’’

সেই পার্থকেই জনসমক্ষে টানতে টানতে গাড়িতে তুলেছেন ইডি-সিবিআইয়ের অফিসাররা। কথা বলতে চাইলে বলতে দেওয়া হয়নি। আদালতে বাধ্য হয়ে তাঁকে বলতে হয়েছে, ‘‘আমাকে বাঁচতে দিন।’’ প্রকাশ্য রাস্তায় আর্তনাদ করতে হয়েছে, ‘‘আমি তো মরে যাব’’ বলে! আবার সেই পার্থই সোমবার আদালতে যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের ধমক দিলেও আদালত থেকে ফেরার পথে বলেছেন, ‘‘আপনারা সবাই ভাল থাকুন। আমি দলের সঙ্গেই আছি।’’

গত ১০০ দিনে ধীরে ধীরে তাঁর প্রতাপ হারিয়েছেন পার্থ।

অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। এমবিএ-ও করেছেন। একটি বহুজাতিক সংস্থার মানবসম্পদ আধিকারিক ছিলেন পার্থ। রাজ্যের উচ্চশিক্ষিত এবং কর্পোরেট শিক্ষাদুরস্ত নেতা বলে পরিচিতি ছিল তাঁর। ‘পরিবর্তন’-এর সরকারে শিক্ষা এবং শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। শুধু তাঁর জন্যই তৈরি হয়েছিল তৃণমূলের ‘মহাসচিব’ পদটি। গ্রেফতার হওয়ার পর গত ১০০ দিনে সেই পার্থ ‘চোর’ বলে জনসমক্ষে অপবাদ শুনেছেন। আদালত চত্বরে তাঁকে দেখে উঠেছে ‘চোর-চোর’ স্লোগান। তাঁকে লক্ষ্য করে ধেয়ে এসেছে ধুলোমাখা চপ্পল। এমনকি, সোমবারও যখন আদালতে নিজের জামিনের আবেদন করছেন পার্থ, তখন তাঁকে ব্যঙ্গ করে শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’-এর সংলাপ আউড়েছেন বিপক্ষের আইনজীবী। হাতে বাতি নিয়ে কোর্টরুমে তিনি বলেছেন সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘‘গোটা সাগরের জলও আমার হাতের রক্ত ধুয়ে ফেলতে পারবে না। বরং লাল হয়ে যাবে।’’

১০০ দিনে তাঁর সম্মানও হারিয়েছেন পার্থ।

কথায় বলে, মান আর হুঁশেই মানুষ। মান গেলে অনেকটাই যায়। গত ১০০ দিনে পার্থ সেই মান খুইয়েছেন। হুঁশ থাকলে হয়তো এই ১০০ দেখতেই হত না তাঁকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন