সতর্কতার বালাই নেই, সস্তার ট্যাটু ডাকছে বিপদ

সে দিন সাজটা ছিল একটু অন্য রকম। পরনে শাড়ি। কানে ঝোলা দুল। ঢিলে করে খোঁপা বেঁধেছিলেন। পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন নায়িকা। খোপার আড়াল থেকে ঘাড়ের কাছে উঁকি দিচ্ছিল, ‘আর কে’।

Advertisement

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৫ ০৪:০৪
Share:

সে দিন সাজটা ছিল একটু অন্য রকম। পরনে শাড়ি। কানে ঝোলা দুল। ঢিলে করে খোঁপা বেঁধেছিলেন। পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন নায়িকা। খোপার আড়াল থেকে ঘাড়ের কাছে উঁকি দিচ্ছিল, ‘আর কে’।

Advertisement

কম হইচই ফেলেনি বিখ্যাত সেই ট্যাটু। নীরবেই দীপিকা ঘোষণা করেছিলেন তাঁর ও রণবীর কপূরের সম্পর্কের কথা। প্রেম অবশ্য টেকেনি। কিন্তু বলিউডের হাত ধরে নিজের পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিল ট্যাটু। ক্রমেই বেড়েছে তার জনপ্রিয়তা। কারও হাতে প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার নাম। কেউ বা নিজেকেই বেশি ভালবাসেন। কারও পায়ে রঙিন নূপুর। কারও বা খোলা পিঠে উঁকি মারছে ড্রাগন। কিংবা কানের নীচে ঘাড়ে কাছে ‘;’।

নয়া প্রজন্মের নতুন এই আকর্ষণ ঘিরেই ভয় পাচ্ছেন ডাক্তাররা। কেন? চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিত্যনতুন গজিয়ে উঠেছে ট্যাটু-শপ। ভয়টা সেখানেই।

Advertisement

দোকান না হোক, শপিং মলের করিডরেই ছোট্ট একটা এক ফালি জায়গা করে পসরা সাজিয়ে বসছেন অল্পবয়সি দোকানি। খরচ অল্পই। উত্তর কলকাতার একটি শপিং মলে খোঁজ করে জানা গেল, হাজার টাকা থেকে শুরু। মধ্যবিত্ত কিংবা সদ্য চাকরি পাওয়া যুবক-যুবতীর পকেটের সাধ্যের মধ্যেই। অন্তত কমবয়সিদের হাতে দামি মোবাইল ফোন তাই তো বলে। শপিং মলের ওই ট্যাটু শিল্পীও জানালেন, ব্যবসা তাঁদের ভালই চলছে। চিকিৎসকদের প্রশ্ন, ‘‘ট্যাটুর প্রতি ঝোঁক তো বাড়ছে, সচেতনতাও বাড়ছে তো!’’ কারণ সামান্য অসাবধানতাই ডেকে আনতে পারে হেপাটাইটিস-বি, এইচআইভি-র মতো বিপদ। এ ছাড়া চামড়ার নানা ধরনের অসুখ তো রয়েইছে।

কী ভাবে রোগ বাসা বাঁধবে শরীরে? চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, এ ধরনের ট্যাটু সাধারণত করা হয় নিডল বা সূচ ফুটিয়ে। নিডল লাগানো থাকে ট্যাটু মেশিনে। সূচের আঘাতেই ত্বকের গভীরে বসে যায় রং, তৈরি হয় ছবি। ব্যবহারের আগে এই সূচ যদি সঠিক ভাবে জীবাণুমুক্ত করা না হয়, বা অন্যের ব্যবহার করা নিডলই শরীরে ফোটানো হয়, তা হলেই বিপদ। ঠিক যেমনটা হয় ইঞ্জেকশনের ক্ষেত্রে।

চর্মরোগের চিকিৎসক সন্দীপন ধরের কথায়, ‘‘যে কোনও হাসপাতালে ভর্তির পর পরীক্ষা করে দেখা হয় রোগীর শরীরে এইচআইভি বা হেপাটাইটিস বি, সি রয়েছে কি না। কারণ একটাই, নিডলের মাধ্যমে ওই রোগীর থেকে অন্যদের শরীরে এইচআইভি বা হেপাটাইটিস সংক্রমণ ঘটতে পারে। কিন্তু হাসপাতালে যে ধরনের সতর্কতা নেওয়া হয়, তা কি এই সমস্ত দোকানেও নেওয়া হয়? আমার তো সন্দেহ আছে।’’

একই বক্তব্য চর্মরোগের চিকিৎসক সঞ্জয় ঘোষেরও। তাঁর কথায়, ‘‘কারও শরীরে এইচআইভি সংক্রমণ হলে তা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে না। হয়তো আক্রান্ত হওয়ার কয়েক মাস পরে দেখা গেল এইচআইভি পজিটিভ। এখন এটা যে ট্যাটু করতে গিয়েই হয়েছে, তা বলা তাই অসম্ভব। কিন্তু অসতর্ক হলে এমনটা হতেই পারে।’’ একই সতর্কবার্তা হেপাটাইটিস-বি-র ক্ষেত্রেও। ‘কলকাতা স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন’-এর চিকিৎসক বিভূতি সাহার মতে, এইচআইভি-র থেকেও সহজে সংক্রমণ ঘটে হেপাটাইটিস বি। এ দেশে এই রোগের ছবিও মারাত্মক।

সন্দীপনবাবু আরও জানান, শুধু এই দু’টি মারণ রোগই নয়, চামড়ার মারাত্মক সব রোগ হতে পারে ট্যাটু থেকে। এর মধ্যে রয়েছে ট্যাটু গ্র্যানুলোমা, ট্যাটু টিউবারকুলোসিস, ট্যাটু সারকয়ডোসিস, ট্যাটু আলসার, কিংবা ডিপ ফাঙ্গাল ইনফেকশন। আর এর কারণ, সস্তার দোকানে নিম্ন মানের রং ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু ‘ট্যাটু’ নতুন হলেও ‘উল্কি’ তো এ দেশে নতুন নয়। বহু প্রাচীন প্রথা। স্বামীর নাম উচ্চারণ নিষেধ। তাই হাতে স্বামীর নামের উল্কি। অনেকে আবার ধর্মীয় উল্কি এঁকে রাখতেন। এ প্রসঙ্গে সন্দীপনবাবুর বক্তব্য, ‘‘হয়তো আগেও ক্ষতি হতো। কিন্তু তার হিসেব কেউ রাখত না।’’

আমেরিকাতে ট্যাটুর চল রয়েছে ব্যাপক ভাবে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি নিয়ন্ত্রক বোর্ডও রয়েছে। যে রং ব্যবহার করা হয়, তা ‘ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (ইউএসএফডিএ) স্বীকৃত। সন্দীপনবাবুর দাবি, ‘‘এ দেশে কসমেটোলজিতে সরকারি নিয়ন্ত্রক বোর্ড-ই নেই! অবাধে চলছে ব্যবসা। আর তা-ই আমাদের কাছে রোগীর ভিড়ও বাড়ছে। কারও হাতে-পায়ে দগদগে ঘা, কারও বা অন্য প্রতিক্রিয়া।’’

কিন্তু যেখানে এত বড় বড় রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি, সেখানে ন্যূনতম প্রশাসনিক সতর্কতা আছে তো?

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্থ-এর গবেষক মধুমিতা দুবে-র বক্তব্য, ‘‘সরকারের তরফে বারবারই নিডল ব্যবহার সম্পর্কে সাবধান করা হচ্ছে। এখন জনে জনে গিয়ে বলা সম্ভব নয়। তবে ট্যাটু-র বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা উচিত, তা মানছি।’’

তা হলে কি যে কেউ এ ধরনের দোকান খুলে বসতে পারেন? মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বললেন, ‘‘এ তো ডার্মাটোলজি-র বিষয়। পৌরসভার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তালিকায় ডার্মাটোলজি বা চামড়ার রোগ অন্তর্ভূক্ত নয়। তা-ই বলতে পারব না।’’

যাঁরা ঝোঁকের বশে হাতে উল্কি আঁকছেন, তাঁদের জন্য আরও একটা বার্তা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ট্যাটু আঁকার থেকে ট্যাটুর তোলার খরচ অনেক বেশি। কারণ তার জন্য দরকার লেসার থেরাপি নয়তো সেলেব্রেসন (জল ও নুন ঘষে উল্কি তোলা হয়)। দু’টো পদ্ধতিই ব্যয়সাপেক্ষ। প্রেম বিদায় নিলেও ট্যাটু তো থেকেই যাবে। সঙ্গে খরচও...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন