কাঠচোরদের রক্ষী করে বন রক্ষার স্বপ্ন

লোকপ্রবাদ বলে, চোর কখনও ধর্মের কাহিনি শোনে না। এটাকে ভুল প্রমাণ করার এক উচ্চাশী প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজ্যের বন দফতর।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৬ ০৩:১৮
Share:

লোকপ্রবাদ বলে, চোর কখনও ধর্মের কাহিনি শোনে না।

Advertisement

এটাকে ভুল প্রমাণ করার এক উচ্চাশী প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজ্যের বন দফতর। ওই দফতরের বিশ্বাস, পেটের টানে যারা কাঠ চুরি করে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়, সৎ পথে রুজিরোজগারের বন্দোবস্ত করে দিতে পারলে তাদের একটা বড় অংশ আইন ভাঙার রাস্তা ছেড়ে দেবে। অর্থাৎ পেট চালানোর এবং সংসার প্রতিপালনের সুস্থ ও বিকল্প উপায় বাতলে দিলে তারা আর অপরাধের দিকে যাবে না। বাঁচবে অরণ্যসম্পদও।

রুজির সেই সুস্থ, সৎ ও বিকল্প রাস্তাটা কী হতে পারে?

Advertisement

সেটাতেও রীতিমতো চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ, বন দফতর যে-পথের কথা ভেবেছে, আপাত ভাবে মনে হতেই পারে, সেটা চোরকে ঘর পাহারা দিতে বলার মতো ব্যাপার! কাঠচোরদের দিয়ে বন পাহারার কাজ করানোর কথা ভাবা হয়েছে। অরণ্য রক্ষার দায়িত্ব পেলে ওই তস্করেরা বাল্মীকি না-হোক, সৎ নাগরিক হয়ে উঠবে— এমনই আশা বন দফতরের।

এতে অন্য একটি লক্ষ্যও পূরণ করতে চাইছে বন দফতর। বন পাহারা দেওয়ার লোকের বড় অভাব। বনের গাছ কেটে যারা কাঠ চুরি করছে, তাদের দিয়ে অরণ্যরক্ষীর কাজ করিয়ে নিতে পারলে সেই কর্মী-ঘাটতির মোকাবিলা করা সহজ হবে। প্রয়োজনে বনসৃজনের কাজে দিনমজুর হিসেবেও যুক্ত করা হবে তাদের। আপাতত মহানন্দা অভয়ারণ্য থেকে কাটা গাছ পাচার ঠেকাতে বন দফতর ও রাজ্য পুলিশের সমন্বয়-বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মনের বক্তব্য, অরণ্য রক্ষা করার জন্য নিছক প্রচারই যথেষ্ট নয়। বেকার, গরিব মানুষের রুজিরোজগারের কথাও ভাবতে হবে। ‘‘কাঠের চোরাকারবারের পান্ডারা টাকার লোভ দেখিয়ে যাদের দিয়ে মহানন্দার জঙ্গল লুটে নিচ্ছে, তাদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে,’’ পথ বাতলে দিচ্ছেন বিনয়বাবু।

আগের চেয়ে চুরি কিছুটা কমেছে। তবে শালকাঠের জন্য বিখ্যাত উত্তরবঙ্গের ১৫৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মহানন্দা অভয়ারণ্য থেকে এখনও যে প্রতি মাসে গড়ে অন্তত এক কোটি টাকার কাঠ পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন বনমন্ত্রী।

অথচ বন পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব মূলত যাঁদের, বন দফতরের সেই ফরেস্ট গার্ড বা বনরক্ষীই নেই পর্যাপ্ত সংখ্যায়। বনরক্ষীর ৫০ শতাংশেরও বেশি পদ শূন্য। যাঁরা আছেন, তাঁদের গড় বয়স ৫২ থেকে ৫৫ বছর। শারীরিক ভাবে পুরোদস্তুর সক্ষম নন তাঁদের অনেকেই। ফলে নজরদারির অভাব থেকেই যাচ্ছে। নতুন নিয়োগ পর্ষদ তৈরি করে রক্ষীর শূন্য পদে লোক নেওয়ার কথা। এবং সেখানে বনবস্তিবাসীরা অগ্রাধিকার পাবেন বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন। তবে সেই প্রক্রিয়ায় নিয়োগে কিছু দেরি আছে।

মহানন্দা অভয়ারণ্যের ক্ষেত্রে বন দফতর ও রাজ্য পুলিশ যৌথ ভাবে কয়েকটি বনবস্তি ও গ্রাম চিহ্নিত করেছে, যেখানকার বাসিন্দারা কাঠ কেটে তুলে দিচ্ছে চোরাকারবারিদের হাতে। সেগুলো হল দশমাইল ও সাতমাইল রেঞ্জ লাগোয়া বনবস্তি ও গ্রাম, মিলন মোড় মৌজা, গুলমা চা-বাগান লাগোয়া বনবস্তি।

বন দফতর ও পুলিশের সমন্বয় বৈঠকের কার্যবিবরণীর উল্লেখ করে রাজ্য পুলিশের জলপাইগুড়ি রেঞ্জের ডিআইজি রাজেশকুমার যাদব সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র দফতরকে জানিয়েছেন, ওই সব বনবস্তি এবং লাগোয়া তল্লাটের বাসিন্দাদেরই বেআইনি ভাবে গাছ কাটার কাজে নিয়োগ করা হচ্ছে টাকার টোপ দিয়ে। রোজগারের এই অবৈধ পথ থেকে ওই বাসিন্দাদের সরিয়ে আনতে হলে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে তাদের যুক্ত করতে হবে। যাতে পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে তাদের রোজগার নিশ্চিত করা যায়। বন দফতর সূত্রের খবর, ওই সব তল্লাটে ১০০ দিনের প্রকল্পে তেমন কাজ মেলে না।

বনমন্ত্রী বিনয়বাবু জানান, ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ তো দিতেই হবে। সেই সঙ্গে দৈনিক মজুরির বিনিময়ে ওই সব এলাকার বাসিন্দাদের বন দফতরের বিভিন্ন কাজে সামিল করা হচ্ছে। ‘‘চারাগাছ পোঁতা এবং বন থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়া হাতি ও বাইসন তাড়ানোর কাজে ওঁদের যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি মহানন্দা অভয়ারণ্যে আমরা এই উদ্যোগের ফল পাব,’’ আশা করছেন বনমন্ত্রী।

পুলিশ ও বন দফতরের যৌথ অনুসন্ধানে কাঠের চোরাকারবারের পান্ডা হিসেবে দশমাইল রেঞ্জের বনবস্তির বাসিন্দা সূর্য রাইয়ের নাম উঠে এসেছে। তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে দার্জিলিঙের পুলিশ সুপারকে। বন দফতরের দাবি, মহানন্দার জঙ্গল থেকে বেআইনি ভাবে কাটা কাঠ চলে যাচ্ছে শিলিগুড়ি লাগোয়া মাটিগাড়ার শিবমন্দির এবং প্রধাননগর এলাকার দার্জিলিং মোড়ে কয়েকটি আসবাবের দোকানে। সেখানে যৌথ ভাবে হানা দেবে বন দফতর ও পুলিশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন