এক প্রৌঢ়ের কীর্তনে মজেছেন বহু মানুষ। উদাত্ত কণ্ঠে গানের সঙ্গে কখনও সে নীতিকথা শোনাচ্ছে। বলছে, ‘ঘাসের মত নরম হও, গাছের মত সহনশীল হও।’ এমন ‘সাধক’ যে খুনের আসামি হতে পারে, সেটা কেউ ভাবতেই পারেনি। পাঁচের দশকের জনপ্রিয় ছবি ‘কুহক’-এ দাগি আসামি উত্তমকুমার আসর মাত করতেন গ্রামের যাত্রায় চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয় করে, গান গেয়ে। তাঁর মুখে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো’ শুনে চোখ দিয়ে জল পড়ত মহিলাদের। একের পর এক খুন করা, নাবালককেও রেয়াত না করা প্রভাস ঢালি-ও ফালাকাটার এক গ্রামে সাধুবেশে মানুষকে বিভোর করে কীর্তন গাইছিল। সেই আসর থেকেই তাকে ধরা হয় ২০১২-র নভেম্বরে।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, উত্তর ২৪ পরগনায় ১৭টি খুন করেছে প্রভাস। অন্তত ৩০টি খুনের আসামি সে। ২০১২-র এপ্রিলে মধ্যমগ্রামের কেমিয়া খামারপাড়ায় এক পরিবারের ৩ জনকে খুনের দায়ে ফাঁসির আদেশ হয়েছে প্রভাস ও তার দুই সঙ্গীর।
সাইকেল চুরি দিয়ে হাতেখড়ি। সুটিয়া গণধর্ষণের মূল আসামি বীরেশ্বর ঢালি, সুশান্ত চৌধুরীদের সঙ্গে মিলেই খুনখারাপি। কিন্তু মহিলা নির্যাতনের প্রতিবাদে সেই দল থেকে বেরিয়ে আসে প্রভাস। কালেদিনে তার নাম হয় ‘মহারাজ’। ডাকাতি, কালোবাজারিদের খুন, ২০০০ সালের বন্যায় সাধারণ মানুষের পাশে থেকে রবিনহুডের ইমেজ গড়ে তোলে সে। কিন্তু একের পর এক খুনখারাপিতে এলাকার বিশ্বাস হারায় প্রভাস। শেষমেশ জেলার ত্রাস হয়ে ওঠে।
নির্মমতার অনেক কীর্তিই রয়েছে প্রভাসের ঝুলিতে। ১৯৯৭ সালে গাইঘাটায় ভ্যান রিকশায় মাইক বেঁধে যাত্রার প্রচার করছিলেন উতু ঘোষ। ওই শব্দে বিরক্ত হয়ে তাঁকে খুন করে প্রভাস। ১৯৯৯ সালে গাইঘাটার বেড়ি এলাকায় প্রদীপ অধিকারী নামে এক জনকে প্রভাস তাড়া করে। প্রদীপ তখন চিরঞ্জিত মণ্ডল নামে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রের পিছনে লুকোয়। দু’জনকেই গুলিতে খুন করে প্রভাস।
এ দিন রামচন্দ্রপুর পল্লিমঙ্গল বিদ্যাপীঠের এক শিক্ষক বলছিলেন, ডাকাতি করতে গেলে এলাকার কয়েক জন মানুষ প্রভাসদের বাধা দিয়েছিলেন। পরদিনই ছিল দ্বাদশ শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষা। ওই স্কুলে গিয়ে গুলি করে, বোমা মেরে, শিক্ষকদের মারধর করে প্রভাস ও তার দল টেস্ট পরীক্ষাই বাতিল করে দিয়েছিল।
বিরোধিতা করে প্রভাসের রোষ থেকে রক্ষা পাননি সাংবাদিক থেকে পুলিশ, মায় জননেতাও। প্রভাসকে ধরতে গেলে উল্টে সে গাইঘাটার তৎকালীন ওসি-কে তাড়া করেছিল। পরে ওই পুলিশ অফিসার যখন সেলুনে দাড়ি কাটাচ্ছেন, সেই সময়ে তাঁকে লক্ষ করে বোমা ছোড়ে। প্রভাসের বিরুদ্ধে মিছিল করতে গেলে তৎকালীন তৃণমূল নেতা, বর্তমানে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে লক্ষ করেও বোমা ছোড়ে প্রভাস ও তার সঙ্গীরা। এ দিন রায়ের পরে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রভাসের মতো পিশাচ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।’’
ফাঁসির আদেশ শুনেও আদালতে দাঁড়িয়ে, দামি জুতো পরা প্রভাস বাঁ পায়ে তাল ঠুকছিল। সে নির্লিপ্ত গলায় বলে, ‘‘সব বেকার।’’ আদালতের এক পুলিশকর্মী বলেন, ‘‘অনেক আসামি দেখেছি। তবে এমন কখনও দেখিনি।’’