ওরা বলল, মেরে ফেললেও কেউ দেখতে আসবে না

রাত তখন দু’টো। আমাদের ঘেরাও চলছিল। হঠাৎ একটা রব উঠল ‘পুলিশ আসছে, পুলিশ আসছে।’ এর মধ্যেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল একদল লোক। ওদের মধ্যে পুলিশের পোশাক পরা কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু অনেকের হাতে লাঠি ছিল। লোকগুলো আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে লাথি, ঘুষি, চড় মারতে থাকল। লাঠি চালানোও বাদ গেল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২১
Share:

রাত তখন দু’টো। আমাদের ঘেরাও চলছিল। হঠাৎ একটা রব উঠল ‘পুলিশ আসছে, পুলিশ আসছে।’ এর মধ্যেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল একদল লোক। ওদের মধ্যে পুলিশের পোশাক পরা কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু অনেকের হাতে লাঠি ছিল। লোকগুলো আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে লাথি, ঘুষি, চড় মারতে থাকল। লাঠি চালানোও বাদ গেল না।

Advertisement

এর মধ্যেই আলো নিভে গেল। অন্ধকারের মধ্যে মারের পাশাপাশি শুরু হল ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি। জামা ছিঁড়ে দেওয়া, শরীরের যেখানে সেখানে হাত দেওয়াসবই চলল। চারদিক থেকে মেয়েদের আর্তচিৎকার ভেসে আসছিল। ওরা আমাদের কয়েক জনকে পাঁজাকোলা করে মাটিতে আছড়ে ফেলছিল। কয়েক জন ছেলেমেয়ে চোখের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তাদের গায়ের উপর দিয়ে হামলাকারীরা হেঁটে যাচ্ছিল। লাঠি দিয়ে দমাদ্দম মারছিল। কয়েক জন ফুলের টব তুলে ছাত্রছাত্রীদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল। টবের আঘাতে এ দিক-ও দিক ছিটকে পড়ছিল অনেকে।

ওদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টায় অন্ধকারে দিশাহারা হয়ে দৌড়োচ্ছিলাম। আমার ঘাড় ধরে দু’জন দেওয়ালের মধ্যে ঠুকে দিল। মাথা ঘুরছিল, হাত-পা অসাড় হয়ে আসছিল। হঠাৎ দেখলাম, আমার ক্লাসেরই এক ছাত্রীকে তিন-চার জন টানতে-টানতে ১ নম্বর গেটের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা চিৎকার করছিল। আমি কোনও রকমে উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বাঁচাতে দৌড়লাম। এই সময়ে কোথা থেকে দু’তিন জন এসে আমার চুলের মুঠি ধরে ধাক্কা দিয়ে গেটের বাইরে নিয়ে গেল। এক জন আমার দু’টো হাত পিছমোড়া করে পিছন থেকে চেপে ধরে থাকল। আরেক জন আমার টি-শার্টটা উপরে তুলে দিল। তার পর অশ্রাব্য কিছু গালাগাল দিয়ে আমাকে পুলিশের ভ্যানে তোলা হল।

Advertisement

ভ্যানে কোনও মহিলা পুলিশ না দেখে আমি প্রশ্ন করলাম, “মহিলা পুলিশ ছাড়া আমাকে আপনারা কী ভাবে গ্রেফতার করছেন?” ওরা দাঁত চেপে হুমকি দিল, “একদম গলাবাজি করবি না। চুপ করে বসে থাক। যদি এখন মেরে রাস্তায় কোথাও ফেলে দিই, কেউ দেখতে আসবে না।” হুমকি শুনে সারা শরীর কেঁপে উঠল। ভয়ে চুপ করে গেলাম। ভ্যান লালবাজারে গিয়ে থামল। এ বার একটু সাহস পেয়ে বললাম, “রাতে কোনও মহিলাকে গ্রেফতার করা যায় না।” তখন আরও একটা পুলিশ ভ্যান এল। তাতে কিছু মহিলা পুলিশ ছিল। ওই ভ্যানে আমাকে তোলা হল। ভ্যান চলতে শুরু করলে, আমি বার-বার গন্তব্য জানতে চাইলাম। কিন্তু কেউ কিছু বলল না।

ভ্যানটি এসে থামল এমআর বাঙুর হাসপাতালে। সেখানে ওরা একটা ফর্ম আনল। আমাকে দিয়ে তাতে জোর করে লেখানো হল, ‘আমি স্বেচ্ছায় শারীরিক পরীক্ষা করাচ্ছি।’ তার পর আমার রক্ত নেওয়া হল। পরে ফের পুলিশ ভ্যানে করে আমাকে যাদবপুর থানায় এনে বসিয়ে রাখা হল। আমি বললাম, আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই। থানার পুলিশ জানাল, আমাকে গ্রেফতার করা হয়নি। আমার নিরাপত্তার জন্যই পুলিশ নাকি আমাকে ‘সেফ কাস্টডি’-তে এনে রেখেছে। জানতে চাইলাম, যে পুলিশ আমাদের এই ভাবে মারল, শ্লীলতাহানি করল, তারা আবার আমাকে কী নিরাপত্তা দেবে? কোনও জবাব পেলাম না। ভোরে ওরা আমাকে ছেড়ে দিল।

বেলার দিকে আমি আবার থানায় গেলাম। পুলিশের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে। তখন ওসি আমাকে বললেন, “আমাদের উপর উপরতলার চাপ রয়েছে। এফআইআর নিতে পারব না।” অনেক ঝামেলা করার পর অবশেষে ওরা এফআইআর নিল। আমি চার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি। তাদের নাম আমি জানি না, তবে দু’জনের চেহারার বর্ণনা আমি এফআইআর-এ দিয়েছি।

লেখিকা: যাদবপুরের নির্যাতিতা ছাত্রী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন