এই ঘরেই ছিল কাশীনাথ পালের দেহ। দেখাচ্ছেন অমরনাথবাবু এবং সর্বাণীদেবী।— নিজস্ব চিত্র
নৈহাটির বরোদা রোডের পালবাড়িতে যেন কলকাতার রবিনসন স্ট্রিটের দে পরিবারের ছায়া!
সৎকার না করে তিন দিন ধরে দাদা কাশীনাথ পালের (৮০) মৃতদেহ আগলে রেখেছিলেন ষাটোর্ধ্ব দুই ভাইবোন— অমরনাথ পাল এবং সর্বাণী পাল। রবিবার দুপুরে বাড়ি থেকে দুর্গন্ধ পেয়ে সন্দেহ হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। তাঁরাই পুলিশে খবর দেন। পুলিশ বিকেলে বাড়িতে ঢুকে একতলার একটি ঘরের মেঝে থেকে দেহটি উদ্ধার করে ময়না-তদন্তে পাঠায়। ফুলে ওঠা দেহটি ঘিরে ভনভন করছিল মাছি আর পোকা। পাশেই লালপেড়ে ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরে বসেছিলেন সর্বাণীদেবী।
দাদার দেহ সৎকার করেননি কেন? অমরনাথবাবু ও সর্বাণীদেবীর অভিযোগ, বৃহস্পতিবার রাতে দাদা কাশীনাথবাবু মারা গিয়েছেন বুঝতে পেরে তাঁরা ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য চিকিৎসকদের সাহায্য চেয়েছিলেন। পাননি। সেই কারণেই দেহ সৎকার করা যায়নি। অমরনাথবাবুর কথায়, ‘‘যখন শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলাম, তখন ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য দু’এক জন চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ এলেন না। পুলিশকেও জানিয়েছিলাম। তারাও ডেথ সার্টিফিকেট আনতে বলল।’’
এ দিন ভাইবোন দু’জনকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের কথাবার্তায় অসংলগ্নতা রয়েছে বলে জানাচ্ছেন পুলিশকর্তারা। তবে ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজকুমার সিংহ বলেন, ‘‘ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার অভিযোগটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিন দিন ধরে মৃতদেহ ঘরের মেঝেতে পড়েছিল বলে জানা গিয়েছে।’’
এই ঘটনায় চলতি বছরের মাঝামাঝি ৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল-কাণ্ডের ছায়া দেখছেন বরোদা রোডের বাসিন্দারা। ওই ফ্ল্যাট থেকে একটি নরকঙ্কাল এবং দু’টি কুকুরের কঙ্কাল উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পরে জানা যায়, নরকঙ্কালটি ওই বাড়ির বাসিন্দা পার্থ দে’র দিদি দেবযানীর। কুকুরগুলি ছিল তাঁর পোষ্য। পার্থবাবু কঙ্কালগুলির সঙ্গে বাস করতেন। তাদের খেতেও দিতেন।
অমরনাথবাবুদের বাড়ি বরোদা রোডে নৈহাটি কাত্যায়নী গার্লস স্কুলের উল্টো দিকে। প্রাচীন দোতলা বাড়ি। দেওয়ালে বট-অশ্বত্থের শিকড়। সদরের নীল দরজা কবে কখন খোলে, খবর রাখে না কেউ। প্রতিবেশীদের কারও সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না পাল পরিবারের। অবিবাহিত তিন ভাইবোনের সংসার ছিল। কাশীনাথবাবুর মৃত্যুর পরে দেহ নিয়ে কী করবেন সেটাই তাঁরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না বলে পুলিশকে জানিয়েছেন অমরনাথবাবুরা।
পুলিশের অনুমান, পুরনো বড় বাড়ি হওয়ায় পচা গন্ধ চট করে বাইরে বেরোতে পারেনি। রবিবার সকাল থেকে গন্ধ ছড়াতে থাকে। বেলা আড়াইটে নাগাদ অমরনাথবাবু একবার বেরনোর জন্য দরজা খুলতেই গন্ধের তীব্রতায় লোকজন এগিয়ে যান। পুলিশকে দুই ভাইবোন জানিয়েছেন, তিন দিনে মাঝেমধ্যে রাস্তায় বেরিয়ে একে-ওকে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া বাকি সময়টা তাঁরা দেহ আগলে বসে থেকেছেন। সর্বাণীদেবী পুলিশকে জানান, দোতলার ঘর ব্যবহারের অযোগ্য। তাই একতলার ঘরেই থাকতেন তাঁরা। বৃহস্পতিবার রাতে খাওয়ার পর শুয়েও পড়েছিলেন। ভোরে উঠে দেখেন কাশীনাথবাবুর দেহ অসাড়। অমরনাথবাবুদের একটি পান, সিগারেট, ঠান্ডা পানীয়ের দোকান আছে নৈহাটি স্টেশনের কাছে। সেটি নিয়মিত খোলা হয় না। শুক্রবার ওই দোকানে গিয়ে অমরনাথবাবু পরিচিত এক আইনজীবী-সহ কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দাদার ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য কোথায় পাবেন। সকলেই চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতে বলে দায় এড়িয়ে যান বলে অভিযোগ। নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক জানান, সৎকারের ব্যবস্থা হচ্ছে। দুই ভাইবোনের যাতে অসুবিধায় না পড়েন, তা-ও দেখা হবে।