রবিবার আর সোমবার রাস্তা বন্ধ করে রাত ১০টার পরে মাইক বাজিয়ে জলসা করে ক্লাবগুলি বুঝে গিয়েছিল আইন যতই ভাঙা হোক না কেন, আইনরক্ষকেরা কিছু করবে না। তাই তাদের সাহস বেড়ে গিয়েছিল। মঙ্গলবার বিসর্জনের শেষ দিনে মজুত শব্দ বাজি ফাটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ক্লাবগুলি। শোভাযাত্রায় সর্বত্র বেজেছে ডিজে। যাকে পুরো কথায় ডিস্ক জকি বললেও, এ ক্ষেত্রে সেগুলি আসলে পেল্লাই আকারের সাউন্ডবক্স। পুলিশ শোভাযাত্রা পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বেআইনি ডিজে বাজেয়াপ্ত করেনি। ডিজে বাজানো এবং শব্দবাজি ফাটানোর জন্য গ্রেফতার করা হয়নি কাউকেই।
আর পুলিশের এই ‘অসহায়’ অবস্থার সুযোগ নিয়ে বুধবার রাতে বিসর্জনের সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও রাস্তায় বের হল কালীপুজোর ভাসানের শোভাযাত্রা। কালীপুজো ও দেওয়ালিতে না ফাটা বাজি সব শেষ হল। আর মধ্য রাতের পরেও ডিজের আওয়াজে রাতের ঘুম নষ্ট হল শহরের বড় একটা অংশের মানুষের। লালবাজারের হিসেবে এই ভাবে সময়সীমার পরে বিসর্জনের শোভাযাত্রা বের করায় একটি মাত্র পুজো কমিটিকে আটকানো হয়েছিল। হেয়ার স্ট্রিট থানা ওই শোভাযাত্রা আটকে পুলিশ পাহারায় প্রতিমা গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। কিন্তু এ তো সিন্ধুতে বিন্দু। অভিযোগ, বাকিদের ক্ষেত্রে পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখেছে। কেন? এর কোনও যুৎসই জবাব লালবাজারের কাছে নেই।
লালবাজার সূত্রের খবর, বুধবার কালীপুজোর বিসর্জনে ডিজে বাজিয়ে শোভাযাত্রা বেরিয়েছে উত্তরের যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ, আমহার্স্ট স্ট্রিট, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, হরিশ মুখার্জি রোড, নেতাজি সুভাষ রোড, আজাদগড়, নেতাজিনগর, রাজা এস সি মল্লিক রোড, গরফা, কসবা, রামলালবাজার, জেমস লং সরণি, উল্টোডাঙা, ফুলবাগান, সিঁথির কালীচরণ ঘোষ রোডে। পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রাগুলিকে দেখেছে। কিছুই করেনি। স্থানীয়দের অনেকেরই অভিযোগ, স্থানীয় থানায় ফোন করলে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা তো নেয়নি, উল্টে পরিচয় জানতে চেয়েছে। বুধবার রাত ১০টা ২০ মিনিট। রিজেন্ট পার্ক পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল কালীপুজোর ভাসানের শোভাযাত্রা। ডিজে, শব্দবাজি, তাসাপার্টি সবই ছিল। এক বাসিন্দা পুলিশ কন্ট্রোলে ফোন করে জানান। কন্ট্রোল থেকে এলাকা জেনে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও কোনও পুলিশের দেখা মেলেনি। সুরাহাও হয়নি। পুলিশ তা-ও শোভাযাত্রাগুলির কাছেপিঠে ছিল। কিন্তু শব্দদূষণ হচ্ছে কি না সেটা যাদের নজরদারি করার কথা সেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্মী-কর্তাদের কাউকে দেখাই যায়নি।
পরিবেশ কর্মীরা জানাচ্ছেন, বুধবার যে সব বিসর্জনের শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল তারা তিনটি নিয়ম ভেঙেছে। নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটিয়েছে। ডিজে ব্যবহার করেছে। আর সরকারের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট দিনের পরে বিসর্জনের শোভাযাত্রা বের করেছে। এক পরিবেশ কর্মীর মন্তব্য, ‘‘আগে কখনও সরকারি সময়সীমার পরে এ ভাবে কোনও পুজো কমিটিকে বিসর্জনের শোভাযাত্রা বের করতে দেখা যায়নি। আসলে আইন ভাঙলে যে কেউ কিছু করবে না, সেটা বুঝে গিয়েছে ক্লাবগুলি। তাই তাদের এমন বেপরোয়া ভাব।’’
কী বলছে লালবাজার?
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেছেন, ‘‘যারা বুধবার বিসর্জনের শোভাযাত্রা বের করে নিয়ম ভেঙেছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’’ কী ধরনের ব্যবস্থা? সুপ্রতিমবাবু বলেন, ‘‘সরকারি নির্দেশ অমান্য করায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮৮ ধারায় ব্যবস্থা নেব।’’ এই ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু যে ক্লাবগুলি সরকারি নির্দেশ ভাঙল তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? সুপ্রতিমবাবু বলেন, ‘‘যে সব ক্লাব নিয়ম ভেঙেছে তাদের তালিকা তৈরি করছি। আগামী বছর তাদের পুজোর অনুমতি দেওয়া হবে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখব।’’
পরিবেশ আইনে ডিজে বাজানো রুখতে কড়া শাস্তির বিধান থাকলেও, প্রকাশ্যে ডিজে বাজানোর কারও বিরুদ্ধে এখনও কোনও মামলা হয়নি বলে লালবাজার সূত্রের খবর। প্রকাশ্যে ডিজে বাজানো নিষিদ্ধ করে ২০১০ সালে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে বিধি তৈরি করেছিল তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, দিনের কোনও সময়েই প্রকাশ্যে ডিজে বাজানো যাবে না। প্রকাশ্যে ডিজে বাজালে ২০০৫ সালের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী পাঁচ বছরের জেল এবং এক লক্ষ টাকার জরিমানা করা হবে। এত কড়া আইন থাকতেও কেন তা পুলিশ কার্যকর করছে না তা নিয়ে পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন পরিবেশ কর্মীদের অনেকেই।
কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কেন নির্লিপ্ত ছিল? দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রর যুক্তি, ‘‘বিসর্জনের ক্ষেত্রে শব্দবাজি ফাটালে কিংবা ডিজে বাজালে নজরদারির দায়িত্বটা পুলিশের উপরেই ন্যস্ত রয়েছে। আইনত ব্যবস্থা নিতে পারে একমাত্র পুলিশই।’’ কল্যাণবাবু বলেন, ‘‘আমরা বিসর্জনের সময়েই মূলত গঙ্গার দূষণটা দেখি। সেখানে আমাদের লোকজন ছিল।’’
আইন আছে, সাজা নেই
আইন কী
২০১০-এর রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিধি
• দিনের কখনও প্রকাশ্যে কোথাও ডিজে বাজানো যাবে না
• বিধি ভাঙলে পরিবেশ সুরক্ষা আইনে ব্যবস্থা
• সাজা- পাঁচ বছরের জেল, এক লক্ষ টাকা জরিমানা কিংবা দুটোই
• নজরদারি করবে পর্ষদ ও পুলিশ
• পরিবেশ সুরক্ষা আইনে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ
কী হয়েছে
• বিসর্জনের শোভাযাত্রায় তারস্বরে বেজেছে ডিজে
• পুলিশ থাকলেও কিছুই করেনি
• পর্ষদের তরফে কোনও নজরদারিই ছিল না
• কোনও ডিজে-ই বাজেয়াপ্ত হয়নি, কোনও ক্লাব-কর্তা গ্রেফতার হননি
• পরিবেশ সুরক্ষা আইনে কারও বিরুদ্ধে কোনও মামলাই করেনি পুলিশ