প্রতীকী চিত্র।
পুরুলিয়ার খটঙ্গায় মাটি খুঁড়ে যা মিলেছে, সেই রকেট-সহ লঞ্চার পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম উদ্ধার হল। তবে সে সব পুরনো অস্ত্র নয়, গোয়েন্দাদের চিন্তায় ফেলেছে শনিবার ভোরে বেলপাহাড়ির শাঁখাভাঙায় পাওয়া দু’টি তাজা ল্যান্ডমাইন। পুলিশের একাংশের প্রশ্ন, এখন জঙ্গলমহলে যা অবস্থা, তাতে মাওবাদীদের মাইন পোঁতার ক্ষমতা হল কী করে?
শিমুলপাল পঞ্চায়েতের শাঁখাভাঙা গ্রাম একেবারে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া। কিন্তু ওই তল্লাটের প্রতিটি গ্রামে এখন একাধিক সিভিক ভলান্টিয়ার। সন্দেহজনক কিছু দেখলে বা শুনলেই তাঁরা খবর দিচ্ছেন পুলিশ বা সিআরপি-কে। শাঁখাভাঙা গ্রামের চার-পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ওদলচুহা, বুড়িঝোরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দু’টি শিবির। গোটা এলাকায় তৃণমূলের জয়জয়কার হয়েছে তিন মাস আগের বিধানসভা ভোটে।
তা-ও তাজা মাইন এল কী ভাবে?
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘বেলপাহাড়ির ওই অঞ্চল ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ লেগেই আছে। ওরাই কোনও ভাবে ঢুকে রাতের অন্ধকারে এটা করেছে।’’ বেলপাহাড়ির কংগ্রেস নেতা সুব্রত ভট্টাচার্যেরও মত, ‘‘২৮ জুলাই থেকে ৩ অগস্ট মাওবাদীরা শহিদ সপ্তাহ পালন করে। এই সময়ে কিছু একটা করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করে। সেটাই হয়েছে।’’
তবে মাওবাদীদের অন্দরের এক সূত্র এই সব দাবি সমর্থন করছে না। সেই সূত্রের বক্তব্য, কার্যকলাপ দূর, জঙ্গলমহলে গতিবিধিও তলানিতে ঠেকেছে। সংগঠনকে নয়া ভাবে গড়তে চাই নিবিড় জনসংযোগ। এই সময়ে হুট করে হিংসার পথ নিলে ফের জনবিচ্ছিন্ন হতে হবে। তাই গণ সংগঠনকে সামনে রেখে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আগে পায়ের তলায় জমি ফিরে পেতে চাইছে মাওবাদীরা।
সম্প্রতি লালগড়ের বেলাটিকরি অঞ্চলের তিলাবনিতে মাওবাদীরা এলাকাবাসীকে নিয়ে বৈঠক করেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের দাবি। আবার বাঁকুড়ার সারেঙ্গার কিছু এলাকায় রাস্তার উপর মাওবাদী পোস্টার ছড়ানো হয়েছে। শহিদ সপ্তাহ শুরুর আগের দিন, দুর্গাপুরে মহকুমাশাসকের অফিসের সামনে রাস্তাতেও মাওবাদীদের বর্ধমান জেলা শিল্পাঞ্চল কমিটির নামে ছাপানো পোস্টার মিলেছে। বেকারত্ব, দারিদ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা বলা হলেও গোপন বৈঠক বা পোস্টারে নাশকতার হুমকি নেই।
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক সূত্রের আবার খবর, গত পাঁচ বছরে নাশকতার ঘটনা না ঘটায় পশ্চিমবঙ্গ যে কোনও সময় ‘সামান্য মাওবাদী প্রভাবিত’ রাজ্যের তালিকায় চলে যেতে পারে। তখন জঙ্গলমহলের ৪২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর অর্ধেক তুলে নেওয়া হতে পারে। তা ছাড়া, মাওবাদী প্রভাবিত রাজ্যগুলোকে কেন্দ্র নিরাপত্তা, জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ-পুনর্বাসন প্রভৃতি খাতে বিপুল অর্থ দেয়। পশ্চিমবঙ্গ প্রতি বছর এই সব খাতে দেড়শো কোটিরও বেশি টাকা পায় বলে রাজ্য সরকারের এক সূত্রে খবর। মাওবাদী প্রভাবিত রাজ্য হিসেবে মর্যাদা খর্ব হলে ওই সব কেন্দ্রীয় সাহায্য কমে যাবে। অথচ পুনর্বাসন প্রকল্পে আরও মানুষকে সামিল করতে রাজ্য সরকার তার যোগ্যতামান অনেকটা শিথিল করেছে। ফলে, খরচ বেড়েছে।
এই অবস্থায় রাজ্যের এক অভিজ্ঞ আইপিএস অফিসারের প্রশ্ন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ যে এখনও মাওবাদী বিপদ মুক্ত নয়, সেটা দেখাতেই ওই নতুন ল্যান্ডমাইন পাওয়া গেল না তো?’’ কিন্তু মাইন তো উদ্ধার করেছে সিআরপি! ওই পুলিশকর্তার বক্তব্য, ‘‘ঝুঁকি ভাতা হিসেবে ৩০ শতাংশ বেশি বেতন পাওয়া যাচ্ছে মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায়। অথচ পশ্চিমবঙ্গে এখন ঝুঁকিই নেই। কেন্দ্রীয় বাহিনীর একাংশ তো দিব্যি আরামে আছে। তারা সেটা চায়।’’
সিআরপি কর্তারা মন্তব্য করতে চাননি। তবে রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা ‘গট-আপে’র অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘আমরা বরাবর বলছি, মাওবাদী কার্যকলাপ পশ্চিমবঙ্গে শূন্যে ঠেকতে পারে। কিন্তু রাশ আলগা দিলেই ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা থেকে ওরা এ রাজ্যে ঢুকে কোনও কাণ্ড ঘটাবে।’’