NIA attacked in Bhupatinagar

এ বার এনআইএ আক্রান্ত বাংলায়, ‘দুঃশাসন’ দেখছে বিজেপি, ‘ভোটমুখী ষড়যন্ত্র’ দেখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা

এনআইএ-র আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক চাপানউতর শুরু হয়েছে। রাজ্যে ‘আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে’ বলে দাবি করে সরব বিজেপি। পাল্টা প্রশ্ন, দু'বছর আগের ঘটনায় ভোটের আগেই কেন ‘সক্রিয়’ এনআইএ?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ২২:১৩
Share:

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে গত ৫ জানুয়ারি তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে ওই নেতার অনুগামীদের হামলার মুখে পড়েছিল ইডি। শনিবার সেই ঘটনার স্মৃতি ফিরিয়ে আনল পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগর। ভূপতিনগর বিস্ফোরণকাণ্ডের তদন্তে গিয়ে শনিবার সকালে হামলার মুখে পড়েন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র আধিকারিকেরা। বিস্ফোরণের ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে প্রথমে আটক এবং পরে গ্রেফতার করা হয় স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতা বলাই মাইতি এবং মনোব্রত জানাকে। বিকেলে তাঁদের কলকাতার বিচার ভবনে হাজির করানো হয়। এনআইএ ধৃতদের পাঁচ দিন নিজেদের হেফাজতে রাখতে চায়। কলকাতার নগর দায়রা আদালতের মুখ্য বিচারক সৌমেন্দ্রনাথ দাস, ধৃত দু’জনকে আগামী বুধবার (১০ এপ্রিল) পর্যন্ত এনআইএ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। আদালতে এনআইএ-র তরফে সওয়াল করে বলা হয়, বিস্ফোরণকাণ্ডের তদন্তের স্বার্থে ওই দু’জনকে হেফাজতে নেওয়া প্রয়োজন। এনআইএ-র উপর হামলা চালানোর জন্যও ওই দু’জনকে দায়ী করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।

Advertisement

তবে লোকসভা ভোটের আগে এনআইএ-র আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক চাপানউতর শুরু হয়েছে। রাজ্যে ‘আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে’ বলে দাবি করে সরব হয়েছে বিজেপি। অন্য দিকে, দু’বছরের পুরনো মামলায় ভোটের আগেই কেন ‘সক্রিয়’ হল এনআইএ, সেই প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, এমনকি, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও ভূপতিনগরের ঘটনা নিয়ে মুখ খুলেছেন। পুলিশ সূত্রে খবর, কার্যত নজিরবিহীন ভাবে ভূপতিনগর থানায় ফোন করে এনআইএ-র উপর হামলার ঘটনা নিয়ে ১২ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট তলব করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

স্থানীয় সূত্রে দাবি, শুক্রবার রাতে এনআইএ অভিযান শুরু হয়, শনিবার সকালে তৃণমূলের দুই নেতাকে গাড়িতে তুলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় কেন্দ্রীয় এজেন্সির গাড়ি ঘিরে ধরেন উত্তেজিত গ্রামবাসীরা। তাঁরা বলাই এবং মনোব্রতকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়ার দাবি করতে থাকেন বলে সূত্রের দাবি। এর পরেই এনআইএর গাড়ির কাচ ভেঙে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। দুই এনআইএ আধিকারিক আহত হয়েছেন বলে জানা যায়। আক্রান্ত হওয়ার পর এনআইএ থানায় যায়। প্রশ্ন ওঠে, পুলিশের কাছে এনআইএ আধিকারিকেরা সাহায্য চেয়েছিলেন কি না, কিংবা পুলিশের তরফেও তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল কি না, তা নিয়ে। পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য জানান, তাদের পক্ষ থেকে তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু তার মধ্যেই পুলিশ খবর পায়, এনআইএ-র তদন্তকারীরা আক্রমণের মুখে পড়েছেন গ্রামে। অর্থাৎ, পুলিশের দাবি, তাদের জানানোর আগেই অভিযান শুরু করে দিয়েছিল এনআইএ।

Advertisement

কী বললেন মমতা

প্রথমে বালুরঘাট, পরে রায়গঞ্জ— জোড়া প্রচারসভা থেকেই ভূপতিনগরের ঘটনা নিয়ে এনআইএ এবং বিজেপিকে আক্রমণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বালুরঘাটের জনসভায় মমতা বলেন, ‘‘গ্রামবাংলায় মাঝরাতে অপরিচিত কাউকে দেখলে গ্রামবাসীরা যা করে থাকেন, তা-ই হয়েছে।’’ এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, ‘‘মাঝরাতে কেন অভিযান চালাতে হল এনআইএ-কে?’’ এখানেই থামেননি তিনি। বিজেপিকে নিশানা করে মমতা বলেন, “বিজেপি কী ভেবেছে, ওরা সব বুথ এজেন্টদের গ্রেফতার করে নেবে? এনআইএ-র কী অধিকার আছে? ওরা বিজেপিকে সমর্থন জোগাতেই এমনটা করছে। আমরা গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে বিজেপির এই নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার আবেদন করছি।’’ রায়গঞ্জের সভা থেকেও বিজেপি, এনআইএ-কে নিশানা করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘ভোটের আগে আমাদের বুথ এজেন্টদের গ্রেফতার করে নেওয়া হচ্ছে। ভোটের প্রচারের কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে। আমিও চ্যালেঞ্জ করছি, যাঁদের গ্রেফতার করেছে, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের, মা-বোনেদের আমি এজেন্ট করব। আমাদের আটকাতে পারবে না।’’ কেন্দ্রীয় সংস্থাটির উদ্দেশে বার্তা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘চকলেট বোমা ফাটালেও এনআইএ চলে আসছে। আরশোলা, ছারপোকা কামড়ালেও মানবাধিকার কমিশনকে পাঠাচ্ছে। আমরা সব নজরে রাখছি। ভুলে যাচ্ছি না। যে অফিসারেরা এটা করছেন, আমি কাউকে ভয় দেখাচ্ছি না, বিজেপি কিন্তু সারা জীবন থাকবে না।’’

কমিশনে নালিশ শুভেন্দুর

ভূপতিনগরে এনআইএ-র উপর হামলার ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে এমনই দাবি করেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এর প্রেক্ষিতে রাজ্য পুলিশের ডিজি, পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার-সহ পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন জানান তিনি। তার পরেই জেলাশাসকের কাছে ঘটনার রিপোর্ট তলব করে কমিশন।

‘গুন্ডামি’ নিয়ে হুঁশিয়ারি বোসের

ভূপতিনগরে এনআইএ আধিকারিকদের উপরে হামলার ঘটনায় সরব হয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও। তিনি বলেন, ‘‘এনআইএ অফিসারদের উপর এ হেন আক্রমণ খুবই গুরুতর ঘটনা। তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে হুমকি দেওয়া, গুন্ডামি করা কোনও কাজের বিষয় নয়। এই ঘটনাকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে।’’ দ্রুত পদক্ষেপ করার কথাও বলেন বোস।

সরব শাহের ডেপুটি

ভূপতিনগরের ঘটনা নিয়ে মুখ খোলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তথা কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক। তিনি বলেন, ‘‘বাংলায় আইনশৃঙ্খলা ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। একের পর এক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার উপর যে ভাবে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। বাংলায় কেন এ রকম ঘটনা বার বার ঘটছে, সেই প্রশ্ন উঠছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যে ভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার উপর হামলার ঘটনা ঘটছে, তা নিয়ে আমরাও অপেক্ষা করব।’’ নয়াদিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে মমতার সরকারকে একহাত নেয় কেন্দ্রীয় বিজেপি। ভূপতিনগরে এনআইএ-র উপর আক্রমণকে ‘সন্দেশখালি ২.০’ বলে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র শেহজাদ পুনাওয়ালা।

এনআইএ-র বিবৃতি

এনআইএ-র তরফে জানানো হয়েছে, পাঁচটি জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে বলাইচরণ এবং মনোব্রতকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মনোব্রতের বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়েছে। সেখানে স্থানীয়েরা আধিকারিকদের বাধাদানের চেষ্টা করেন। এনআইএ-র এক আধিকারিক অল্প চোটও পেয়েছেন। কয়েক জন সংস্থার গাড়িতে হামলা চালিয়েছে। এনআইএ-র দাবি, ভূপতিনগর থানায় যেতে আধিকারিকদের বাধা দেওয়া হয়েছে। সেখানে গ্রেফতারি সংক্রান্ত প্রক্রিয়া শেষ করার কথা ছিল এনআইএ-র। সেই থানায় যেতেই বাধা দেওয়া হয়। এই নিয়ে স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে এনআইএ।

কমিশনে যাচ্ছে তৃণমূল

ভূপতিনগরে এনআইএ-র ভূমিকা নিয়ে ‘অতিসক্রিয়তা’র অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। ইতিমধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনারের সময় চাওয়া হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। তৃণমূলের প্রতিনিধি দলে মোট ১০ সদস্য থাকবেন বলে জানা গিয়েছে। এর পাশাপাশি, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভূপতিনগরে তৃণমূলের প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রবিবার রাজ্যের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং কুণাল ঘোষ তাঁর নির্দেশে ভূপতিনগর যাবেন। দলীয় কর্মীদের গ্রেফতারির প্রতিবাদে ভূপতিনগর থানার অর্জুননগর-সহ একাধিক জায়গায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে, পথ অবরোধ করে বিক্ষোভে শামিল হন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।

এক সুর বাম-কংগ্রেসের

ভূপতিনগরের ঘটনা নিয়ে সিপিএম, কংগ্রেসেরও সুর কার্যত একই। তাদের দাবি, এই ঘটনাই প্রমাণ করল যে, রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। তার পাল্টা জবাব এসেছে তৃণমূলের তরফ থেকেও। রাজ্যের শাসকদলের পাল্টা দাবি, এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা কমিশনের হাতে। তাই এ বিষয়ে রাজ্য প্রশাসনকে আক্রমণ করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তৃণমূল নেতারা। পুলিশ সূত্রে খবর, এনআইএ গোয়েন্দারা ভূপতিনগরে যাবেন সে কথা জানিয়েছিলেন স্থানীয় থানায়। কিন্তু অভিযোগ, এনআইএ স্থানীয় থানার বাহিনী পৌঁছনোর অপেক্ষা না করেই গ্রামে ঢুকে যায় এবং তল্লাশি শুরু করে।

কোন ঘটনার তদন্তে এনআইএ?

২০২২ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব মেদিনীপুরের নারুয়াবিলার গ্রামে রাজকুমার মান্নার বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিনিও তৃণমূল নেতা ছিলেন। রাজকুমার নিজে গুরুতর জখন হন। জখম হন বিশ্বজিৎ গায়েন এবং বুদ্ধদেব মান্না। পরে তিন জনেরই মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর রাজ্য পুলিশ ওই তিন জনের মৃত্যুতে এফআইআর দায়ের করে। এর পর, উপযুক্ত ধারা প্রয়োগ এবং এনআইএ-র হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়ার আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে হলফনামা দায়ের হয়। ২০২৩ সালের ২১ মার্চ নতুন ধারা প্রয়োগের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। সেই ঘটনাতেই দুই নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন