বদলে চলেছে ওসি, পাড়ুই আছে পাড়ুইয়ে

গুলি-বোমার লড়াইয়ের বিরাম নেই। প্রশ্ন উঠছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। এক দিকে শাসক দলের হয়ে পক্ষপাতের অভিযোগ তো রয়েইছে, অন্য দিকে গত এগারো মাসে বদলি হয়েছেন চার জন ওসি। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দলের নেতাদের ‘তুষ্ট’ করতে না পারলেই রোষের মুখে পড়ছেন ওসি-রা। বদলি করে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

পাড়ুই শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৫ ০৩:৩৪
Share:

গুলি-বোমার লড়াইয়ের বিরাম নেই। প্রশ্ন উঠছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। এক দিকে শাসক দলের হয়ে পক্ষপাতের অভিযোগ তো রয়েইছে, অন্য দিকে গত এগারো মাসে বদলি হয়েছেন চার জন ওসি। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দলের নেতাদের ‘তুষ্ট’ করতে না পারলেই রোষের মুখে পড়ছেন ওসি-রা। বদলি করে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের।

Advertisement

সোমবার রাত থেকে শাসক দলের সঙ্গে বিজেপির এলাকা দখলের পুরনো লড়াই ফের শুরু হওয়া এবং তার জেরে ওসি বদলি দেখে স্থানীয় গ্রামবাসীদের তাই হা-হুতাশ, ‘‘পাড়ুই আর বদলাবে না, শুধু ওসি বদলে যাবে!’’

গত জুলাই থেকে এগারো মাসে বদলে গিয়েছেন পাড়ুই থানার চার জন অফিসার ইন চার্জ। তবে দু’পক্ষের বিবাদে যে ছেদ পড়েনি, পুলিশের হিসেবই তা কবুল করছে। গত এগারো মাসে পাড়ুইয়ের মাখড়া, চৌমণ্ডলপুর, ছাতারবাঁদি কিংবা গোরাপাড়ার মতো গ্রামগুলিতে ৫১ বার। তাহলে ঘন ঘন ওসি বদলি করে লাভ?

Advertisement

জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘গণ্ডগোল বাধলেই ক্ষতর উপরে একটা ব্যান্ডেজ জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। দিন কয়েক পরে ব্যান্ডেজ খুললে দেখা যাচ্ছে ক্ষত সারেনি, তখন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে ব্যান্ডেজ। আসলে ক্ষতে ওষুধ না লাগিয়ে শুধু ব্যান্ডেজ বদল করে লাভ কী!’’

তাঁর কটাক্ষের মধ্যেই ওসি বদলের নেপথ্য কাহিনী লুকিয়ে রয়েছে। দিন কয়েক আগে অমরজিৎ বিশ্বাস নামে ওই ওসি বদলির পরে জেলা পুলিশের একাংশ যে বেশ ক্ষুব্ধ, তাঁদের কথাতেই তা স্পষ্ট। জানাচ্ছেন, ‘লড়াই’ থামিয়ে পাড়ুইকে পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে দিতে গেলে দলমত নির্বিশেষে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করা প্রয়োজন। প্রয়োজন গ্রামে ঢুকে সব দলের ‘দুষ্কৃতীদের’ ঘরে তল্লাশি চালানো। এক পুলিশ কর্তার প্রশ্ন, ‘‘তা না করতে পারলে পাড়ুইয়ের ক্ষতে ওষুধের প্রলেপ পড়বে না। শুধু ব্যান্ডেজ বদলে কি শান্তি ফেরে?’’

গত সোমবারের ঘটনার পর পাড়ুই থানায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে নীলোৎপল মিশ্রকে। বছর খানেক আগে উত্তপ্ত পাড়ুই শিরোনামে উঠে আসার পরে প্রথম কোপ পড়েছিল এই নীলোৎপলবাবুর উপরেই। তারপর ক্রমান্বয়ে বোমাবাজি এবং পাল্লা দিয়ে ওসি বদলিতে ছেদ পড়েনি।

নীলোৎপলবাবুকে সরিয়ে থানার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রামকানাই চক্রবর্তীকে। তবে— ভরদুপুরে বোমা, রাতের আঁধারে ঘরের চালায় ধরিয়ে দেওয়া আগুনে দাউ দাউ জ্বলতে থাকা গৃহস্থ বাড়ি কিংবা লাঠি-হাঁসুয়ার কোপে গ্রামবাসীদের আহত হওয়ার ঘটনার কোনও বিরাম ছিল না। তার জেরে সরে যেতে হয়েছিল তাঁকে।

যদিও জেলা পুলিশের পদস্থ কর্তাদের একাংশ মনে করছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না বলে থানার ওসিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা নিছকই ‘নিয়মমাফিক’, ওসি বদলির মূল কারণ, শাসক দলের হয়ে যথেষ্ট ‘ইতিবাচক’ কাজ করতে না পারা। এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘পাড়ুইয়ের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা স্থানীয় থানার ওসি-র বিরুদ্ধে জেলা নেতাদের কাছে অভিযোগ করলেই পুলিশ সুপারের কাছে ওসি বদলির সুপারিশ চলে আসে, এর পরে নিচুতলার পুলিশের মনোবল বলে কিছু থাকে!’’

তৃণমূলের এক তাবড় জেলা নেতা অবশ্য ওসি বদলির পিছনে এমন কারণ মানতে চাননি।

রামকানাইবাবুর পরে পাড়ুইয়ের ওসি হয়েছিলেন প্রসেনজিৎ দত্ত। তাঁকেও বদলি করা হয় মাস কয়েকের মধ্যে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই সময়ে, শাসক দলের দাপটকে দাবিয়ে রেখে, মাখড়া, চৌমন্ডলপুর, ছাতারবাঁদি কিংবা গোরাপাড়ার মতো গ্রামগুলি বিজেপি-র আঁতুর ঘর হয়ে উঠেছিল। পুলিশের খাতায় এই সময়ে পাড়ুইয়ের নামকরণ হয়ে গিয়েছিল ‘অরেঞ্জ জোন’। প্রসেনজিতের উপরে কোপ পড়তে বিলম্ব হয়নি।

আসেন কার্তিকমোহন ঘোষ। তবে তাঁকে সরতে হয়েছিল আদালতের নির্দেশে। জেলা পুলিশের একটি অংশ জানান, কার্তিকবাবুর উপরে শাসক দল বেশ ‘সদয়’ ছিল। কিন্তু বিজেপি-র এক মহিলা কর্মীর গায়ে বিচুটি পাতা ঘষে মারধর করার দায়ে আদালতের নির্দেশেই তাঁকে সরিয়ে মাস দুয়েক আগে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অমরজিৎ বিশ্বাসকে। পুলিশে্র একটি সূত্র বলছে, এ বার শাসক দলের অভিযোগে সরে যেতে হল তাঁকেও।

জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, সরকার চাইলে ওসি বদল করতেই পারে। তবে পাড়ুইকে পুরনো চেহারায় ফেরাতে গেলে বীরভূমের চারটি ব্লক ছুঁয়ে থাকা পাড়ুই এলাকার অধিকাংশ গ্রামের ‘গোপন’ আস্তানা থেকে ‘অস্ত্র-ভাণ্ডার’ উদ্ধার করা দরকার।

বীরভূমের জেলা তৃণূল নেতারা মানতে না চাইলেও বিরোধী নেতারাও দাবি করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীকে খুশি করতে মিথ্যা রিপোর্ট না দিয়ে জেলা পুলিশ কর্তাদের উচিত এ বার অন্তত ‘নিরপেক্ষ’ কাজ করুন পুলিশ কর্মীরা। না হলে?

এক পুলিশ কর্তা বলছেন, ‘‘না হলে, পাড়ুই থেকে বোমার ধোঁয়া কাটবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন