গ্রেফতারির মাপকাঠি অপরাধ নয় ঝান্ডার রং, বলছে পুলিশেরই একাংশ

পুলিশ এক কিন্তু নীতি দুই! খাস কলকাতাতেই কোনও গোলমাল দেখে পুলিশ জড়োসড়ো হয়ে গুটিয়ে থাকে। তদন্ত শেষ করেও সময় মতো চার্জশিট জমা দিতে পারে না। আবার কোনও হাঙ্গামায় পুলিশের সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৫ ১৯:৩৪
Share:

পুলিশ এক কিন্তু নীতি দুই!

Advertisement

খাস কলকাতাতেই কোনও গোলমাল দেখে পুলিশ জড়োসড়ো হয়ে গুটিয়ে থাকে। তদন্ত শেষ করেও সময় মতো চার্জশিট জমা দিতে পারে না। আবার কোনও হাঙ্গামায় পুলিশের সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করাই শুধু নয়, উত্তেজিত জনতার মধ্যে থেকেই পাকড়াও করে অভিযুক্তদের। কেন এই ফারাক?

পুলিশের একাংশ বলছে, ফারাক গড়ে দেয় অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয়। শাসক দলের কর্মীদের ক্ষেত্রে পুলিশি তৎপরতা ততটা চোখে পড়ে না, যতটা চোখে পড়ে বিরোধীদের ক্ষেত্রে। বৃহস্পতিবার বামেদের মিছিলে পুলিশের লাঠি চালানোর ঘটনা পুলিশের একাংশের এই বক্তব্যের সমর্থনে জ্বলন্ত প্রমাণ। বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল থেকেই চন্দন বসাক, অমল পাল ও সৌমেন পাল নামে তিন বাম সমর্থককে গ্রেফতার করেছে বৌবাজার থানা। তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশকে খুনের চেষ্টা, সরকারি কর্মীর কাজে বাধা দেওয়া, হাঙ্গামা করা, বেআইনি জমায়েত করার অভিযোগ এনেছে পুলিশ। শুক্রবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে হাজির করিয়ে তাঁদের পাঁচ দিনের জন্য হেফাজতেও নিয়েছে পুলিশ।

Advertisement

এই কলকাতাতেই কিন্তু প্রকাশ্য রাজপথে গুলি-বোমাবাজি চালানোর পরও শাসক দলের নেতাদের টিঁকি ছোঁয়ার সাহস দেখাননি লালবাজারের কর্তারা। রাজপথে ওসিকে নিগ্রহ করার পরেও গ্রেফতার করা হয়নি মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতাকে। প্রকাশ্যে ট্রাফিক পুলিশকে নিগ্রহ করার পরেও ছাড় পেয়েছেন মেয়রের ভাইঝি। কলকাতার একটি থানার ওসি বলছেন, ‘‘গ্রেফতার না হয় ছেড়েই দিলাম, তদন্ত শেষ করে চার্জশিটও কি জমা দিতে পেরেছে?’’

পুলিশই বলছে, আলিপুর, কাশীপুর কিংবা মেয়রের ভাইঝি কাণ্ড— কোনওটাতেই এখনও চার্জশিট জমা দেওয়া হয়নি।

গত ১৪ এপ্রিল আলিপুরের গোপালনগর মোড়ে বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের সভা ঘিরে গোলমালের অভিযোগ ওঠে। পুলিশ সূত্রের খবর, সেখানে গিয়ে নিগৃহীত হন খোদ আলিপুর থানার ওসি চন্দন রায় মুখোপাধ্যায়। সেই ঘটনার এফআইআরে এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহা এবং তাঁর দলবলের নাম থাকলেও কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে আলিপুর আদালত থেকে জামিন পান প্রতাপ। সেই মামলায় এখনও চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিশ।

১৫ এপ্রিল কাশীপুরে বোমাবাজি ও গুলি চলার ঘটনায়ও নাম জড়িয়েছিল স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতা স্বপন চক্রবর্তী ও আনোয়ার খানের। সিসিটিভিতে ধরাও পড়ে গোলমালের ফুটেজ। কয়েক জন চুনোপুঁটিকে গ্রেফতার করলেও স্বপন বা আনোয়ারের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস হয়নি পুলিশের। লালবাজার সূত্রের খবর, শিয়ালদহ আদালত সমন জারি করলেও তা কার্যকর করেনি কাশীপুর থানা। ওই ঘটনায় আহত হয়েছিলেন মুন্না সিংহ নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি। তাঁর আইনজীবী অনুপম ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, পুলিশ এই মামলায় প্রথম থেকেই গা-ছাড়া মনোভাব দেখাচ্ছিল। এ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত’র এজলাসে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার মামলাও করা হয়েছে। অনুপমবাবু বললেন, ‘‘শিয়ালদহ আদালতের সমন কেন কার্যকর করা হয়নি, তা নিয়েও হাইকোর্টে আলাদা মামলা চলছে। বিচারপতি ঈশানচন্দ্র দাস পুলিশের কাছে সমন কার্যকর না করার ব্যাখ্যা চেয়েছেন।’’

পুলিশ সূত্রেই জানা যাচ্ছে, ওই ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে শাসক দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের নিচুতলার কর্মীরা প্রস্তুত। কিন্তু উপরতলার কর্তাদের ইচ্ছা অন্য রকম। তাই তাঁদের নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে নিচু তলার কর্মীরা ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে বেশি তৎপরতা দেখালে মাথার উপর শাস্তির খাঁড়া নেমে আসার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। এই প্রসঙ্গেই কলকাতা পুলিশের এক ওসি বলছেন, কাশীপুরের ক্ষেত্রে তদন্তকারী অফিসার সিসিটিভির ফুটেজ জোগাড় করেছিলেন। ধৃত ও সাক্ষীদের বয়ানেও স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতার নাম ছিল। কিন্তু চার্জশিট তৈরির কাজ শেষ হওয়ার আগেই অন্য একটি অভিযোগে তাঁকে থানা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তদন্তের ভার দেওয়া হয় অন্য এক অফিসারকে।

পুলিশের একাংশ বলছেন, শাসকের তাঁবে থাকতেই এক শ্রেণির পুলিশ অফিসার নিজেদের কার্যত দলদাসে পরিণত করেছেন। বাহিনীকে তাঁরা নিজেদের মর্জিমাফিক চালাচ্ছেন। লালবাজারের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘বিরোধী দলের নেতা হলেই এই অফিসাররা সক্রিয় হয়ে ওঠেন আর শাসক দলের বিরুদ্ধে মামলা হলেই তদন্তকারী অফিসারের উপরে নানা উপায়ে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।’’ এই অফিসারদের কারণেই গোটা বাহিনীকে মাঝে মধ্যে সীমাহীন লজ্জায় পড়তে হয়। কী রকম?

লালবাজারের এক কর্তা বলছেন, গত ১৪ নভেম্বর আলিপুরে সরকারি জমি থেকে দখলদার উচ্ছেদ করতে গিয়ে আক্রান্ত হন পূর্ত দফতর ও পুলিশে আধিকারিকরা। ভরদুপুরে আলিপুর থানায় ঢুকে হামলা চালানো হয়। নিজেদের বাঁচাতে পুলিশ টেবিলের তলায় ঢুকে ফাইল দিয়ে মুখ ঢাকে। এই ছবি সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার পরও ওই ঘটনায় অভিযুক্ত শাসক দলের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। বরং ঘটনার পর দিন যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করানো হয়েছিল তাঁরা কেউই আলিপুর এলাকার ত্রিসীমানায় থাকেন না।

কলকাতা পুলিশের এক প্রবীণ অফিসার বলছেন, ‘‘গ্রেফতারি দেখিয়ে নিজেদের ঘাড় তেকে দায় ঝেড়ে ফলতেই যে পুলিশ ওঁদের গ্রেফতার করেছিল তা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল।’’ ওই ঘটনার পর মুখ বাঁচাতে তদন্তকারী অফিসার বদল করা হয়। পরে বদলি হন থানার ওসি বুদ্ধদেব কুণ্ডুও। বস্তুত, ওই ঘটনাতেও মূল চাঁই হিসাবে নাম উঠে এসেছিল মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার। কিন্তু চার্জশিটে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ খাড়া করতে পারেনি আলিপুর থানা। তারও আগে দক্ষিণ শহরতলির সন্তোষপুরের তৃণমূল নেতা সঞ্জয় দাসের বিরুদ্ধে পুলিশ পেটানোর অভিযোগ ওঠে। তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়নি।

বিরোধী দলের নেতাদের অনেকেই বলছেন, পরিবর্তনের জমানায় এই রীতি অস্বাবাবিক নয়। ২০১১ সালে জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে গোলমালে জড়িয়েছিল তৃণমূলপন্থী একটি ক্লাবের সদস্যরা। তাঁদের কয়েক জনকে পাকড়াও করা হলে মাঝ রাতে ভবানীপুর থানায় হাজির হয়ে অভিযুক্তদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশের অনেকেই বলছেন, শাসক দল গোলমাল করলে পুলিশ কী করবে, কার্যত সে দিনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ‘‘তাই বিরোধী দলের ক্ষেত্রে পুলিশের এই সক্রিয়তা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’’

কলকাতা পুলিশের অনেকেই বলছেন, ইদানীং শাসক দলের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গেলে থানার সাব ইন্সপেক্টর বা ওসির হাতে তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকে না। থাকে লালবাজারের শীর্ষ মহল এবং শাসক দলের নেতাদের হাতে। সেই নিয়ন্ত্রণের গেরোয় পড়ে অনেক সময়ই আসল অভিযুক্তদের পাকড়াও করতে পারেন না নিচুতলার কর্মীরা। যা নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে বাহিনীর অন্দরে। এক তরুণ পুলিশ অফিসার বলছেন, কাশীপুরের ক্ষেত্রে লালবাজার থেকে আনোয়ার খানকে পাকড়াও করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু নীচুতলা বার্তা দেয়, গোলমালে আনোয়ার যেমন জড়িত তেমনই স্বপনও জড়িত। গ্রেফতার করতে হলে দু’পক্ষকেই করতে হবে। নিচুতলার মনোভাব বুঝে কাউকেই গ্রেফতার না করার নির্দেশ দেয় লালবাজার। কলকাতা পুলিশের এক মাঝারি মাপের আধিকারিক বলছেন, আলিপুরে ওসি নিগ্রহের ঘটনাতেও সিসিটিভি ফুটেজ, সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করা হলেও তদন্ত এগোয়নি। কারণ, যথার্থ তদন্ত করতে গেলে সত্যিটা বেরিয়ে আসবে। আর তাতে বিব্রত হবেন লালবাজারের শীর্ষ পদাধিকারীরাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন