বদলের হাওয়া টিকবে না, আশা শাসক দলের

কোন রোষে লোকসভায় নিজের গড়েও ভোট হারাল তৃণমূল? কাটমানি-ক্ষোভও অব্যাহত। জেলায় জেলায় অন্বেষণলোকসভা নির্বাচনে ভোটের অঙ্কে বিজেপি’র তুলনায় পনেরো হাজারের বেশি ভোটে ওই বিধানসভায় পিছিয়ে তৃণমূল। কেন এমন হল?

Advertisement

ফিরোজ ইসলাম

রানিবাঁধ শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৯ ০৪:০৯
Share:

শুনুক পাহাড়ীর হাট। নিজস্ব চিত্র

স্থানীয়েরা বলেন, সংসারে লাগে অথচ শুনুক পাহাড়ীর হাটে পাওয়া যায় না, এমন জিনিস নাকি নেই।

Advertisement

এক সময় হিন্দু মহাসভার শক্ত ঘাঁটি বাঁকুড়া থেকে খাতড়ার দিকে যেতে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ওই হাট বসে। প্রতি সোমবার।

এক দিনের সাপ্তাহিক ওই হাটের দিকে তাকিয়ে থাকেন পঞ্চানন হাঁসদাঁ, গুরুপদ মণ্ডল, মজনু খানের মতো আশপাশের ৩০-৪০ টি গ্রামের কমবেশি লাখ খানেক বাসিন্দা। পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরনো হাটে পাওয়া যায় জরুরি জিনিস, গ্রামবাসীদের তৈরি ঘরোয়া জিনিসপত্র, শুকনো মাছ, হাঁস-মুরগি, সব ধরনের গৃহপালিত পশু।

Advertisement

বহু বছর ধরে, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থেকে গবাদি পশু নিয়ে হাটে আসেন মহম্মদ বেলাল এবং তাঁর পরিচিতেরা। কথায় কথায় বেলাল বললেন, ‘‘কোথায় কী হয়েছে বলতে পারব না। অনেক দিন এই হাটে আসছি। এখনও কোনও সমস্যায় পড়িনি।’’

হাটেই দেখা হল, রাজেন মাহালি, রঘু মুর্মুদের সঙ্গে। দুজনের কারও নির্দিষ্ট কোনও জীবিকা নেই। সামান্য চাষাবাদ ছাড়া আয় হয় পশু পালন থেকে। কখনও সখনও কাজ জোটে অন্যের জমিতে। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের টাকা পাননি ? রাজেনের কথায়, ‘‘সেভাবে কাজই তো হতে দেখলাম না। টাকা কোথায় পাব। যে টুকু পেয়েছি তাতে দিন দশেকের খোরাকিও চলে না।’’

রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন ? দুজনেই জানালেন, সে সব হয়েছে বটে। তবে তাতে নাকি হাল ফিরেছে গ্রামে তৃণমূলের নেতা আর ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের। আর ভোট? রঘু বললেন, ‘‘পঞ্চায়েতে ভোট আর দিতে পারলাম কোথায়? সব তো নেতারাই মেরে দিচ্ছে।’’

পরের গন্তব্য জঙ্গলমহলের সারেঙ্গা, রানিবাঁধ এলাকা। চায়ের দোকানে বসে কথা হচ্ছিল রানিবাঁধের এক তৃণমূল নেতার সঙ্গে।

লোকসভা নির্বাচনে ভোটের অঙ্কে বিজেপি’র তুলনায় পনেরো হাজারের বেশি ভোটে ওই বিধানসভায় পিছিয়ে তৃণমূল। কেন এমন হল? নেতা বললেন, ‘‘বাইরে থেকে আসা নেতাদের নিচু তলায় তাকানোর সময় কোথায় ? ঘনিষ্ঠ লোকজনকে নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত পুলিশকে নির্দেশ দিতে। এভাবে দল চলে নাকি ? মানুষ সেই ক্ষোভই উগরে দিয়েছে ভোটের বাক্সে।’’ পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলেরই একাংশ লদ্দা গ্রামে বুথ দখলের চেষ্টা করেছিলেন কীভাবে, তাও শোনালেন ওই নেতা। গ্রামবাসীদের সম্মিলিত প্রতিরোধে চারটি গাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। তারপরে দলেরই কারও কারও নামে মামলা হয়। সে সব এখনও চলছে। কীভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে দল? বললেন, ‘‘জেলার দায়িত্বে বদল এসেছে। পুরনো কর্মীদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাতে মানুষের ক্ষোভ কিছুটা কমবেই।’’

রানিবাঁধে বিজেপির মণ্ডল সভাপতি অভিজিৎ মণ্ডল অবশ্য তা মনে করেন না। তাঁর কথায়, ‘‘শাসকদলের নেতাদের হিংসা আর বঞ্চনায় মানুষ এতটাই ক্ষিপ্ত যে জঙ্গলমহলে আমাদের প্রচারের ক্ষেত্রে সেভাবে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়নি।’’

বাঁকুড়া শহরের পরিপ্রেক্ষিত অবশ্য কিছুটা আলাদা। ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু মহাসভার শক্ত ঘাঁটি বাঁকুড়ায় সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারে বিভাজনের পালে হাওয়া লাগেনি, তা হলফ করে বলতে পারছেন না বাম নেতারাও। পুর এলাকায় ভোটের বিভাজন স্পষ্ট। সেই বিভাজন ক্রমেই চওড়া হচ্ছে অন্যান্য এলাকাতেও। লোকসভা নির্বাচনে বাঁকুড়ার সিপিএম প্রার্থী অমিয় পাত্রের মতে, মানুষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে গিয়ে বিজেপিকে বেছে নিয়েছেন। তাতে ভবিষ্যতের জন্য আশঙ্কা থাকলেও বিজেপি’র পালের এই হাওয়া থাকবে না। তিনি মনে করালেন, ১৯৫২ সালের নির্বাচনে বাঁকুড়ায় হিন্দু মহাসভা তিনটি আসন জিতলেও সেই হাওয়া স্থায়ী হয়নি।

বাঁকুড়া শহরে রথতলা মোড়ের গোপীনাথপুর গলিতে বিজেপি’র জেলা অফিসে অবশ্য ইদানীং লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। অপরিসর কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের বসার ব্যবস্থা করতে ভাড়া করে চেয়ার এনে রাখা হয়েছে উঠোনে। ‘বেনোজল’ নিয়ে আশঙ্কার মধ্যেই ২০২১ সালের কথা ভেবে সংগঠন বাড়ানোর মরিয়া চেষ্টা করছেন সদ্য নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকার। শিবির পাল্টানোর চলতি ঝোঁকের মধ্যে বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের এক নেতা অবশ্য মানতে চাইলেন না পরিস্থিতি এতটা খারাপ। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি লোকসভাতে আগেও ভোট পেয়েছে। কিন্ত বিধানসভায় সুবিধে করতে পারেনি।’’

ভরা বর্যার গন্ধেশ্বরী কিংবা দ্বারকেশ্বরের চেহারা দেখে বাঁকুড়ার জলকষ্ট অনুমান করা শক্ত, বলছিলেন শহরের হোটেলের এক কর্মী।

তাই কি ‘বন্যার জল’ সরে গেলে মাটি দেখতে পাওয়ার আশা করছেন জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব?

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন