East Bengal Mohun Bagan

কলকাতা ফুটবলের গ্যালারি এখন রাজ্য-রাজনীতির নতুন মঞ্চ, বিজেপির ভাষ্য রবির ডার্বিতে, পাল্টা দেওয়ার প্রস্তুতি

সিএএ-বিরোধী বা বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে দুই প্রধানের সমর্থকদের ব্যানারের ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন তৃণমূল, সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা। আবার রবিবারের ব্যানার পোস্টারের ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারেরা।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২৫ ১৫:১৪
Share:

(উপরে) মোহনবাগান গ্যালারিতে প্রদর্শিত পোস্টার, ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে প্রদর্শিত ব্যানার (নীচে)। ছবি: সংগৃহীত।

গ্যালারির মধ্যে গ্যালারি। ভাষ্যের পাল্টা ভাষ্য। আগে গ্যালারি তাকিয়ে থাকত মাঠের দিকে বল দখল দেখতে। এখন গ্যালারি তাকাচ্ছে গ্যালারির দিকে। দেখছে গ্যালারি দখলেরই লড়াই। কলকাতা ফুটবলের গ্যালারি এখন রাজ্য-রাজনীতির নতুন মঞ্চ।

Advertisement

এনআরসি, সিএএ নিয়ে তখন দেশ জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলনের আবহে ২০২০ সালের একটি ডার্বিতে যুবভারতীতে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে এনআরসি এবং সিএএ-এর বিরুদ্ধে ব্যানার ঝুলিয়ে লেখা হয়েছিল, ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে না’। যার সঙ্গে মিল ছিল তৎকালীন ‘কাগজ দেখাব না’ (কাগজ নহি দিখায়েঙ্গে) স্লোগানের সঙ্গে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তখন পাল্টা কোনও ‘ভাষ্য’ দেখা যায়নি ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান গ্যালারিতে। যা দেখা গেল চলতি ডুরান্ড কাপে।

টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে দুই প্রধানের সমর্থকদের একাংশ ব্যানার ঝুলিয়েছিল ভিন্‌রাজ্যে বাঙালিদের উপর আক্রমণ এবং বাংলাভাষার অপমানের বিরুদ্ধে। যা আপাতত বঙ্গ রাজনীতির অন্যতম বিষয়। যে বিষয়কে হাতিয়ার করে বিজেপির বিরুদ্ধে চড়াদাগের আন্দোলন শুরু করেছে তৃণমূল। পথে নামছে বামেরাও। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরা কার্যত স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, বাঙালিদের উপর ‘আক্রমণ’ ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে বাংলার শাসকদলের অন্যতম প্রধান ‘বিষয়’ হতে চলেছে।

Advertisement

সিএএ-এর সমর্থনে মোহনবাগান গ্যালারিতে পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।

বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণ নিয়ে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে ব্যানার প্রদর্শনের দিনই লাল-হলুদ সমর্থকদের একাংশ এমন ‘স্পর্শকাতর’ রাজনৈতিক বিষয়কে গ্যালারিতে নিয়ে আসার বিরোধিতা করেছিলেন। যাঁরা ওই ব্যানার ঝোলানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে তখন পাল্টা বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে যখন হিন্দুদের উপর আক্রমণ হচ্ছিল, তখনও গ্যালারিতে তার প্রতিবাদে ব্যানার ঝুলেছিল। সে দিনই অনেকে অনুমান করেছিলেন, ওই ব্যানারের পাল্টা ব্যানার আসতে চলেছে।

সেইমতোই রবিবার ডুরান্ডের কোয়ার্টার ফাইনালে দুই গ্যালারিতেই ব্যানার-পোস্টারে দেখা গেল বিজেপির ভাষ্য। সরাসরি সিএএ-এর পক্ষে পোস্টার। ব্যানারের স্লোগানে মনে করিয়ে দেওয়া হল, ওপার বাংলা থেকে কাদের জন্য উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল এখনকার ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের পূর্বপুরুষদের।

রবিবারের ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে লাল-হলুদ ব্যানারে লেখা ছিল, ‘যাদের জন্য ছাড়লাম দেশ, তারাই পরেছে বাঙালির বেশ’। তার নীচে ইংরেজিতে, ‘সেভ হিন্দু রিফিউজিস, উই সাপোর্ট সিএএ।’ আর মোহনবাগান গ্যালারির পোস্টারে লেখা ছিল, ‘প্রতিটি হিন্দু শরণার্থী আমার ভাই, অনুপ্রবশকারীর ঠাঁই নাই’। সবুজ-মেরুন রঙের উপর সাদা দিয়ে একই স্লোগান লেখা ব্যানার দেখা গিয়েছে স্টেডিয়াম লাগোয়া বিধাননগরের একটি আইল্যান্ডেও।

এর আগে সিএএ-বিরোধী বা বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে দুই প্রধানের সমর্থকদের ব্যানারের ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন তৃণমূল এবং সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা। কারণ, তাঁদের রাজনৈতিক ভাষ্যের সঙ্গে ওই ব্যানারের মিল ছিল। ঠিক তেমনই রবিবারের ব্যানার এবং পোস্টারের ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে বাহবা দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারের মতো বিজেপি নেতারা। সুকান্ত লিখেছেন, ‘গতকাল হয়তো খেলার ময়দানে ইস্টবেঙ্গল জিতেছে, কিন্তু আসল জয় এসেছে দুই দলের সমর্থকদের একতার মধ্যে — তাঁরা একসাথে জিতেছেন লাখো হিন্দুর বিশ্বাস, অশ্রু আর ভালোবাসা। সেই মুহূর্তে ফুটবল খেলা আর খেলা ছিল না — সেটি তখন পরিণত হয়েছিল একতাবদ্ধ মানুষের হৃদস্পন্দনে।’ আর শুভেন্দু লিখেছেন, ‘হিন্দু শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা। তবে এই আবেগের প্রকাশকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে পুলিশ ও প্রশাসন। সকাল থেকে টাঙানো সমর্থকদের বড় বড় টিফো, ব্যানার কেড়ে নিয়েছে মমতা পুলিশ। এটা স্পষ্ট কণ্ঠরোধ করার প্রয়াস, কিন্তু বাঙালিদের ঐক্য ও আবেগ কেউ দমাতে পারবে না, কোনওদিন পারেওনি।’

গ্যালারির বিভাজন চিরকালীন। ডার্বি ম্যাচে দুই গ্যালারি কার্যত দুই পৃথিবী। কিন্তু রবিবারের পরে ‘গ্যালারির মধ্যে গ্যালারি’ তৈরি হয়ে গিয়েছে। এর আগে বাংলাভাষী ও বাঙালিদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে গ্যালারিতে পোস্টার ঝোলানোর নেপথ্যে ভূমিকা নিয়েছিল দুই প্রধানের সমর্থকদের মধ্যে ‘বাম মনোভাবাপন্ন’ গোষ্ঠী। তৃণমূলেরও কেউ কেউ জুড়ে ছিলেন সেই পরিকল্পনায়। রবিবারের প্রদর্শিত ব্যানার পোস্টারের নেপথ্যে ভূমিকা নিয়েছে বিজেপি। সমগ্র বিষয়টির তত্ত্বাবধান করেছেন উত্তর কলকাতার এক পরিচিত বিজেপি নেতা। মোহনবাগান গ্যালারিতে দু’টি পোস্টারের সেট প্রদর্শিত হয়েছে। যার একটিতে সবুজের উপর হলুদ অক্ষর। অন্যটিতে লালের উপর হলুদ। ব্যানার-উদ্যোক্তাদের সূত্রের খবর, লাল-হলুদ সেটটি যাওয়ার কথা ছিল ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে। কিন্তু সংগঠকদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবের জন্য গ্যালারির সঙ্গে পোস্টারের মিলমিশ হয়নি।

প্রসঙ্গত, গত বছর আরজি করের ঘটনার পরে যৌথ প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকেরা। ওই ঘটনার পরে নাগরিক বিক্ষোভের আবহে এই যুবভারতীতে এই ডুরান্ড কাপেরই ইস্টবেঙ্গল-মোহানবাগান ডার্বি বাতিল করেছিল পুলিশ-প্রশাসন। সেই বাতিল ম্যাচের দিন অঝোর বৃষ্টি উপেক্ষা করেও যুবভারতীর আশেপাশে জড়ো হয়েছিলেন দুই প্রধানের সমর্থকেরা। যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা ময়দানের তৃতীয় প্রধান মহমেডান ক্লাবের সমর্থকেরাও। পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস। সে দিনের সেই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন মোহনবাগানের অধিনায়ক শুভাশিস বসু। সবুজ-মেরুন সমর্থক কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন লাল-হলুদ সমর্থককে। স্লোগান উঠেছিল— ‘আমাদের বোনের বিচার চাই’। মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে কটাক্ষ করে দুই প্রধানের সমর্থকদের গলায় শোনা গিয়েছিল, ‘এক হয়েছে বাঙাল-ঘটি, ভয় পেয়েছে হাওয়াই চটি।’ কলকাতা লিগের বিভিন্ন ম্যাচে গোলপোস্টে পিছনের ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে প্রতিবাদী ব্যানার দেখা গিয়েছিল। তাতে লেখা থাকত, ‘তিলোত্তমার রক্তচোখ, আঁধার রাতে মশাল হোক’। কিন্তু স্লোগানের পাল্টা স্লোগান, ভাষ্যের পাল্টা ভাষ্য প্রদর্শন রবিবারই প্রথম দেখা গেল।

এবং সেই পরম্পরা রবিবারেই থেমে যাচ্ছে না। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের একাংশের মধ্যে রবিবারের পাল্টা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ডার্বি জিতে ইস্টবেঙ্গল ডুরান্ডের সেমিফাইনালে পৌঁছে গিয়েছে। শেষ চারে লাল-হলুদের প্রতিপক্ষ ডায়মন্ড হারবার এফসি। যে ক্লাবের মাথায় রয়েছেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক। আগামী বুধবার যুবভারতীতেই নামবে দুই দল। রবিবারের ‘পাল্টা’ বুধবারে কী হবে, তার পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেকে বলছেন, অভিষেকের ডায়মন্ড হারবারও বিজেপি-র পাল্টা ভাষ্য নিয়ে গ্যালারিতে হাজির হতে পারে। ডায়মন্ড হারবারের সেই অর্থে সমর্থকদের বৃহৎ কোনও গোষ্ঠী নেই। হলে কী ভাবে তা বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়েও কৌতূহল রয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement