সীমানা পেরোতে লরিপিছু গুনাগার ২০ হাজার পর্যন্ত

হ্যালো... ষোলশো চল্লিশ? ...হ্যাঁ হ্যাঁ, গাড়ি ধাবাতেই রাখুন। বর্ডারে এখন এন্ট্রি নিচ্ছে না। আমি ফোন করলে স্টার্ট দেবেন। বুধবার ভোর সাড়ে ৫টা। ঝাড়খণ্ড সীমানায় বরাকরের ডুবুরডিহি চেকপোস্টের সামনে রাস্তার উপরে মোটরবাইক রেখে মোবাইলে কথা বলছিলেন এক যুবক। আটকে থাকা আলুর ট্রাকের চালকদের পইপই করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁদের দেওয়া টাকা সঠিক হাতে পৌঁছে গিয়েছে, এ বার চেকপোস্ট খুললেই রওনা।

Advertisement

সুশান্ত বণিক

বরাকর শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪২
Share:

ডুবুরডিহি চেকপোস্টার কাছে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাক। ছবি: শৈলেন সরকার

হ্যালো... ষোলশো চল্লিশ? ...হ্যাঁ হ্যাঁ, গাড়ি ধাবাতেই রাখুন। বর্ডারে এখন এন্ট্রি নিচ্ছে না। আমি ফোন করলে স্টার্ট দেবেন।

Advertisement

বুধবার ভোর সাড়ে ৫টা। ঝাড়খণ্ড সীমানায় বরাকরের ডুবুরডিহি চেকপোস্টের সামনে রাস্তার উপরে মোটরবাইক রেখে মোবাইলে কথা বলছিলেন এক যুবক। আটকে থাকা আলুর ট্রাকের চালকদের পইপই করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁদের দেওয়া টাকা সঠিক হাতে পৌঁছে গিয়েছে, এ বার চেকপোস্ট খুললেই রওনা।

খোলা বাজারে দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজ্যের দাওয়াই, ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানো চলবে না। নানা কারণ দেখিয়ে ট্রাক আটকানো হচ্ছে সীমানায়। আর তার পরেই সক্রিয় হয়ে উঠছে একটি চক্র। যাঁদের বৈধ কাগজপত্র আছে, সেই ব্যবসায়ীদেরও ট্রাক পার করাতে নানা অছিলায় ‘গুনাগার’ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।

Advertisement

চেকশার্ট-জিনস পরা যে যুবক মোবাইলে অবিরাম নির্দেশ দিয়ে চলেছেন, তিনি কে? নাম বললেন ‘শুভ’ (আসল না নকল, কে জানে)। কী কাজ তাঁর? ‘দু’দিকে রফা করিয়ে দেওয়া আলুর ট্রাক চেকপোস্টে এগিয়ে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। বাকি সব সেটিং করা আছে’ মুচকি হেসে মোটরবাইকে স্টার্ট দেন তিনি।

ভোর সাড়ে ৪টে থেকে এলাকায় চক্কর কেটে তত ক্ষণে বোঝা হয়ে গিয়েছে, ‘রফা’ মানে কী। নামপ্রকাশ না করার শর্তে শুভরই মতো কয়েক জন জানিয়েছেন, কৃষি বিপণন দফতর এবং এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কর্মীদের একাংশের সঙ্গে টাকার রফা করিয়ে আলুর ট্রাক ও পাশে যেতে দেওয়া হচ্ছে। ওই কাকভোরেই চেকপোস্টের বেশ কিছুটা আগে গোটা কুড়ি আলুর ট্রাক রাস্তার পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। জনা কয়েক যুবক চালকদের সঙ্গে কথা বলছেন। সরকারি কর্মীরা দাঁড়িয়ে চেকপোস্টের কাছে।

বহু আলু ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ভিন্ রাজ্যে যাওয়ার কাগজ হাতে থাকলেও গাড়ি আটক করা হচ্ছে। অবস্থা এমনই যে, অচেনা মুখ জানলা দিয়ে কথা বলতে গেলেই তাকে ‘দালাল’ ধরে নিচ্ছেন ট্রাক চালকেরা। এই প্রতিবেদক কথা বলার চেষ্টা করা মাত্র এক চালক যেমন বললেন, “নদিয়া থেকে আলু নিয়ে এসেছি। আপনাদের লোককে টাকা দিয়ে দিয়েছি।”

ট্রাকের আশপাশে ঘোরাফেরা করা যুবকেরা জানালেন, ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোর কড়াকড়ি শুরু হওয়ার পর থেকেই দিনভর ‘কাজ’ করছেন তাঁরা। পিছনে চারটি ট্রাকের মিছিল নিয়ে মোটরবাইকে চেকপোস্টের দিকে যাচ্ছিলেন এক যুবক। তিনিই বুঝিয়ে দিলেন “আলুর মালিকের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলা, কৃষি বিপণন এবং এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে রফা করানো এবং মোটরবাইকে চড়ে সঙ্গে গিয়ে ট্রাক বর্ডার পার করানো পুরো কাজই আমরা করছি। গাড়ি পেরিয়ে গেলে তবে নিশ্চিন্তি।”

ট্রাক পিছু কত করে দিতে হচ্ছে?

তাপস গড়াই নামে এক যুবক বলেন, “এই ধরুন, চার থেকে কুড়ি হাজার। ভোরে তখন টাকা কম। বেলা বাড়লে গাড়ি বাড়ে। কাজের ঝুঁকিও বাড়ে। তখন টাকা বেশি।” তাঁর অভিযোগ, “সরকারি কর্তাদের বেশিটা দিতে হচ্ছে। তার পরে তো মিঠুনদাকে (এই যুবকদের নেতা) গাড়ি পিছু দু’হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে।”

সকাল ৯টা। চেকপোস্ট থেকে ফিরতি পথে তখনও ধাবা, পেট্রোল পাম্পে আলুর ট্রাক দাঁড়িয়ে। বিনোদ উমরা নামে এক ট্রাকচালক জানান, পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা রোড থেকে উত্তরপ্রদেশের কানপুরে আলু নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মঙ্গলবার মধ্যরাতে এই পেট্রোল পাম্পে পৌঁছন। তাঁর কথায়, “মালিকের সঙ্গে ফোনে বর্ডারের লোকের কথা হয়েছে। কখন রওনা হতে হবে, ফোন করে জানাবে বলেছে। এখনও ডাক আসেনি।”

বর্ধমানের এক হিমঘর থেকে আলু নিয়ে রাজস্থানের জয়পুরে যাচ্ছেন ট্রাকচালক সঞ্জয় সর্দার। তিনি বলেন, “মালিক বলেছে, টাকা দেওয়া আছে। লোক এসে গাড়ি নিয়ে যাবে।” কেন তাঁরা এ ভাবে টাকা দিচ্ছেন? অরুণ চৌধুরী নামে বর্ধমানের এক আলু ব্যবসায়ীর বক্তব্য, “বর্ডারে ঘুষ দিতে হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু রাজ্যের বাইরে আলু পাঠাতে না-পারলে না খেতে পেয়ে মারা যাব। বড় ক্ষতি সামাল দিতে এই ছোট ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে।”

চেকপোস্টে এনফোর্সমেন্ট বিভাগ বা কৃষি বিপণন দফতরের কর্মীরা এ নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি। বর্ধমান জেলা কৃষি বিপণন আধিকারিক সন্দীপ দাসের দাবি, “এমন অভিযোগ প্রথম শুনলাম। আলু ব্যবসায়ীদের সংগঠন আমার কাছে টাকা চাওয়ার অভিযোগ করেনি। ওই এলাকার চেকপোস্টগুলিতে যে ‘রেগুলেটরি মার্কেটিং কমিটি’ কাজ করে, তার প্রধান মহকুমাশাসক। ওঁরা হয়তো বলতে পারবেন।”

আসানসোলের মহকুমাশাসক অমিতাভ দাস সেখানকার এনফোর্সমেন্ট বিভাগেরও দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক। তিনি বলেন, “মার্কেটিং কমিটি মূলত অন্যায় ভাবে আলু মজুত করা হচ্ছে কি না, তা দেখছে। টাকা নিয়ে ট্রাক ভিন্ রাজ্যে যেতে দেওয়ার যে অভিযোগ উঠছে, তা কাম্য নয়। খোঁজ নিয়ে দেখব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন