বাড়তি ফলনে তলানিতে আলুর দাম, সঙ্কটে চাষিরা

স্ত্রী-ছেলেদের নিয়ে মাঠ থেকে আলু তুলছিলেন নিতাই ঘোড়ুই। এ বার দাম কেমন? প্রশ্ন শুনেই মুখটা শুকিয়ে গেল পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনার কালিকাপুরের এই চাষির।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:১৯
Share:

রাস্তায় আলু ফেলে বিক্ষোভ। মেদিনীপুরে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

স্ত্রী-ছেলেদের নিয়ে মাঠ থেকে আলু তুলছিলেন নিতাই ঘোড়ুই। এ বার দাম কেমন? প্রশ্ন শুনেই মুখটা শুকিয়ে গেল পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনার কালিকাপুরের এই চাষির। মাথা নীচু করে বললেন, “প্রতি বিঘায় আলু চাষে খরচ পড়েছিল ১৯ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি ফলন হয়েছে প্রায় ৯০ বস্তা আলু। তা বেচে যদি ১০ হাজার টাকা মেলে তাতেও ৯ হাজার টাকা লোকসান।”

Advertisement

বর্ধমানের আউশগ্রামের আলু চাষি ভরত ঢালিরও মন ভার। বলছিলেন, ‘‘বস্তা পিছু চাষের খরচ যেখানে ২০০ টাকারও বেশি, সেখানে আলুর বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। কী ভাবে ধার শোধ করব জানি না।’’

নোট বাতিলের ধাক্কায় আলু চাষের সময় চাষিদের হাতে এ বার কার্যত কোনও টাকাই ছিল না। সে ধাক্কা সামলাতে বেশিরভাগ চাষিই মোটা টাকা ধার করে আলু বুনেছিলেন। আশা ছিল, ভাল দাম পেলে সঙ্কট সামলে নেবেন। কিন্তু আপাতত সেই আশায় জল। রাজ্যের প্রধান তিন আলু উত্পাদক জেলা হুগলি, বর্ধমান এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে এক বস্তা (৫০ কিলোগ্রাম) আলুর দাম এখনও ৮০ থেকে ১০০ টাকার বেশি ওঠেনি। অথচ, গত বছর ৫০-৬০ বস্তা ফলন হলেও মাঠ থেকেই চাষিরা ৪৫০-৫০০ টাকা দরে প্রতি বস্তা আলু বিক্রি করেছিলেন। চাষের খরচ বাদ দিয়েও চাষিদের ঘরে ঢুকেছিল বিঘা প্রতি গড়ে সাত থেকে আট হাজার টাকা।

Advertisement

কেন আলুর দর তলানিতে? কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়তি ফলনের জেরেই আলুর এই মন্দা বাজার। গতবারও আলুর প্রচুর ফলন হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের পরেও বহু আলু মজুত ছিল হিমঘরে। গতবারের সেই আলুর খানিকটাও রয়ে গিয়েছে অনেকের কাছে। এ বার আলু চাষের জন্য আবহাওয়া ছিল অনুকূল। টানা অনেকদিন শীত ছিল। আলুতে রোগপোকার সংক্রমণও কম হয়েছে। ফলে, জলদি আলুর ফলন হয়েছে প্রচুর। সব মিলিয়ে দাম কমেছে আলুর।

রাজ্যের জন্য সাধারণত কম-বেশি ৯০ লক্ষ মেট্রিক টন আলু লাগে। বাড়তি আলু ওড়িশা, অসম, উত্তরপ্রদেশ এবং পঞ্জাবে রফতানি করা হয়। আলুর রফতানির বাজার ওই সব রাজ্যে আলুর কতটা ফলন হল, তার উপর নির্ভর করে। ফলে, এ রাজ্যে আলুর ফলন বেশি হলে রফতানি করে চাষি ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন, এমন সম্ভাবনাও সব সময় থাকে না। কৃষি দফতরের এক কর্তা আবার মনে করিয়ে দিলেন, “আলু কিন্তু এখনও পুরোপুরি মাঠ থেকে ওঠেনি। ফলে এ বার ঠিক কতটা আলুর ফলন হয়েছে, তার সঠিক হিসাব এখনই পাওয়া সম্ভব নয়।” হুগলির ধনেখালির কানানদী এলাকার চাষি কাশীনাথ কোলের আশঙ্কা, “আলুর দাম যে ভাবে নামছে, তাতে কয়েক দিনের মধ্যে ৫০ টাকা বস্তা হয়ে যাবে। চাষি তখন আর মাঠ থেকে আলু ঘরেই তুলবে না।”

গত কয়েক বছর রাজ্যের কৃষি দফতর প্রচার করছে, চাষে লাভ পেতে আলু আর ধানের চৌহদ্দি ছেড়ে বেরোতে হবে। প্রথাগত চাষ ছেড়ে বিকল্প চাষে মন দিতে হবে। সে জন্য অর্থ সহায়তাও দেবে সরকার। কিন্তু চাষিরা এখনও সেই বিঘের পর বিঘে জমিতে আলু চাষেই আটকে রয়েছেন। তাই বাড়তি ফলনে আলুর দাম কমে গিয়ে ভুগতে হচ্ছে এ রাজ্যের চাষিদের। গত কয়েকটি মরসুমে অবশ্য এ রাজ্যে আলুর দাম ভালই বেড়েছিল। তখন রাজ্য সরকার ভিন্‌ রাজ্যে আলুর অবাধ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সড়কপথগুলিতে শুরু হয় পুলিশি নজরদারি। ভিন্‌ রাজ্যমুখী বহু আলুর ট্রাক আটক করা হয়। ওই পরিস্থিতির পরে কয়েকটি মরসুমে দেখা যায়, পুলিশি আতঙ্কে আলু চাষে কিছুটা হলেও লাগাম পড়েছিল। ফলন কম হওয়ায় চাষিরা আলুর ভাল দামও পেয়েছিলেন। কিন্তু এ বার ফের প্রচুর আলু চাষ হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ফলনও। তারই মাসুল গুনছেন চাষিরা।a

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন