আলু বিকোল বেশি দামে, বাধা দিলেন না কর্তারাই

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। সেই নির্দেশ যাতে কার্যকর করা হয়, শনিবার সে জন্য ছিল নজরদারিও। কিন্তু এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ (ইবি) ও কলকাতা পুরসভার অফিসারদের সামনেই ২০-২২ টাকা কেজি দরে আলু বেচলেন দোকানিরা। এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিল না প্রশাসন। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পুরকর্তাদের একাংশ বলছেন, “আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি খুচরো দোকানিরা পাইকারিতেই ১৪ টাকার বেশি দরে আলু কিনছেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৪ ০৩:০৫
Share:

সরকারি উদ্যোগে বিক্রি হচ্ছে আলু। কিনতে লম্বা লাইন ক্রেতাদের। শনিবার হাতিবাগান বাজারে। —নিজস্ব চিত্র

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। সেই নির্দেশ যাতে কার্যকর করা হয়, শনিবার সে জন্য ছিল নজরদারিও। কিন্তু এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ (ইবি) ও কলকাতা পুরসভার অফিসারদের সামনেই ২০-২২ টাকা কেজি দরে আলু বেচলেন দোকানিরা। এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিল না প্রশাসন। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পুরকর্তাদের একাংশ বলছেন, “আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি খুচরো দোকানিরা পাইকারিতেই ১৪ টাকার বেশি দরে আলু কিনছেন।

Advertisement

তা হলে কী ভাবে খুচরোর দাম তার চেয়ে কম হবে?” এই বাস্তবটা বুঝেই তাঁরা শুধু ‘নজরদারি’ চালিয়ে ক্ষান্ত দিয়েছেন কর্মসূচিতে।

আলু দোকানি ও খুচরো ব্যবসায়ীদের অনেকে বলছেন, যা ইবি ও পুরসভার অফিসারেরা বুঝতে পেরেছেন, তা প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা বুঝতে চাইছেন না। ১৪ টাকা কেজি দরে আলু বেচতে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা। যে কাণ্ডটা ঘটলে পথে বসতে হতে পারে অনেক দোকানিকে।

Advertisement

তাঁরা আঙুল তুলছেন আলু-অর্থনীতির অঙ্কের দিকে। বলছেন, চাহিদা অনুযায়ীই জিনিসের দাম বাড়ে-কমে। এ বার প্রথম থেকেই আলুর চাহিদা বেশি ছিল। সে জন্য দাম যে বেশি হবে, সেটা তো স্বাভাবিক।

কিন্তু এ বার যে পরিমাণ আলু হয়েছে, তাতে রাজ্যে তো ঘাটতি থাকার কথা নয়। হিমঘর মালিকদের সংগঠন এবং প্রশাসনের একটা অংশই জানাচ্ছে, রাজ্যে আলুর চাহিদা বছরে গড়ে ৬০ লক্ষ টন। সেখানে উৎপাদন হয় ৮০-৮৫ লক্ষ টন। এর মধ্যে প্রায় ৩০ লক্ষ টন আলু চাষিরা সরাসরি মাঠ থেকেই ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন। তাঁদের কাছ থেকে পাইকারিদের হাত ঘুরে সেই আলু ঢোকে খোলা বাজারে। বাকি যায় হিমঘরে। এ বারেও তার অন্যথা হয়নি।

তা হলে? ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, আসলে এ বারে চাহিদা বেড়েছে অন্য রাজ্যে। এ বছর পাকিস্তান প্রচুর আলু আমদানি করেছে ভারত থেকে। আর সেই আলুর জোগান দিয়েছে পঞ্জাব, গুজরাত ও উত্তরপ্রদেশের মতো আলু উৎপাদক রাজ্যগুলো। ফলে তাদের ভাঁড়ারে হঠাৎই টান পড়েছে। সেই ঘাটতি পূরণ করতে তারা পশ্চিমবঙ্গের কাছ থেকে আলু কিনতে চাইছে। এ রাজ্যের ব্যবসায়ীরা বিহার, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডে আলু রফতানি করেন। এ বার তার সঙ্গে পঞ্জাব, গুজরাত ও উত্তরপ্রদেশ যোগ হওয়ায় চাহিদা বেড়েছে। ফলে আলুর দাম বাড়তে বাধ্য। ব্যবসায়ীরাই জানাচ্ছেন, গত বছর যেখানে ৫০ কেজির প্যাকেট পিছু ২৫০ টাকা দাম পেয়েছিলেন চাষিরা, সেখানে তাঁরা পেয়েছেন ৩৫০-৩৮০ টাকা। তাঁরা বলছেন, এই দামে মাঠ থেকে হিমঘর ও পাইকারি বাজার হয়ে খুচরো বাজারে যখন আলু এসে পড়ে, তখন তার দাম কেজি প্রতি ১৪ টাকার বেশি। সরকারের বেঁধে দেওয়া দরে আলু বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না খুচরো বিক্রেতাদের। আর সেই বাস্তবটা বুঝেই তাঁদের বাধা দিতে পারেননি ইবি ও পুর অফিসারেরা।

এই ব্যবসায়ীদের একাংশের তাই বক্তব্য, খুচরো দোকানদারদের উপরে নজরদারি চালিয়ে কী হবে! দাম নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি যদি চালাতেই হয়, তবে সেটা হিমঘরেই করা উচিত। একই কথা বলছেন প্রশাসনেরও একাধিক অফিসার। তাঁদের বক্তব্য, এখন হিমঘরে ব্যবসায়ীরা কত দিন আলু মজুত করে রাখবেন (যাকে হোর্ডিং বলে ব্যাখ্যা করছে প্রশাসনের লোকজন), তার উপরেই নির্ভর করছে, আলুর দাম বাড়বে কি না। এ বারে বাজারে যে হেতু চাহিদা রয়েছে, তাই হোর্ডিং-এর সম্ভাবনা বেশি বলেই মনে করছেন প্রশাসনিক অফিসারেরা। সে ক্ষেত্রে নজরদারিটা সেখানেই করা উচিত বলে তাঁদের বক্তব্য। তা না করে হঠাৎ খুচরো বাজারে আলুর দাম বেঁধে অর্থনীতিই ধাক্কা খাবে। ব্যবসায়ীরা সেই লোকসান সামলাবেন কী ভাবে?

প্রশাসনের এক অফিসার বলেই ফেললেন, “এ তো গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার মতো ব্যাপার!”

কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা কি আদৌ এই কথাটা বুঝতে পারছেন? নবান্ন সূত্র কিন্তু সে কথা বলছে না। এ দিন ফের সেখানে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি, এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) ও কৃষি বিপণন দফতরের সচিবকে নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখনই ভিন রাজ্যে আলু পাঠানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে না। বিভিন্ন সীমানায় যে সমস্ত আলুবোঝাই ট্রাক আটকে রাখা হয়েছে সেগুলি কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হবে (যদিও শনিবার কয়েকটি ট্রাককে রাজ্য প্রশাসন ওড়িশায় যেতে দিয়েছে বলে খবর)। তার পর সরকারের বেঁধে দেওয়া ১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হবে।

আলু ব্যবসায়ীদের একটা অংশের অভিযোগ, অর্থনীতির নিয়ম থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেই এ সব করছে সরকার। তাঁরা বলছেন, সরকার সব গাড়ি আটকে না রেখে প্রতিদিন ৫০-৮০টা করে লরি ছাড়তে পারত। এতে এক দিকে আলু ব্যবসায়ীদের বিরাট টাকা গুণাগারও দিতে হতো না। আবার অন্য রাজ্যেও আলুর জোগানে তেমন ঘাটতি হতো না। কিন্তু তার বদলে দু-তিন দিন ধরে রাস্তায় ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখার ফলে ওই আলু পচতে শুরু করেছে বলে জানাচ্ছেন আলু ব্যবসায়ীরা। এই কথা বলে পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক বিভাস দে জানালেন, শনিবারেও আটক করা অনেক ট্রাক প্রশাসন ছাড়েনি। প্রতিবাদে কাল, সোমবার কর্মবিরতি পালন করা হবে। সে দিন কেউ হিমঘর থেকে আলু বের করবে না, পাইকারি বাজারেও আলু বিক্রি হবে না।

রাজ্য প্রশাসন অবশ্য আলু ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগ মানতে চায়নি। বরং কৃষি বিপণন দফতরের অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, খোলা বাজারে আলুর দাম বাড়ার ফলেই হিমঘরে আলু ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। তাই যা করার হিমঘর থেকেই করতে হবে, কলকাতার খুচরো বাজারে নয়। কিন্তু হিমঘরেও আদৌ নজরদারিরও কোনও দরকার আছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। কারণ, হিমঘর মালিক এবং প্রশাসনের একটি অংশের হিসেব দেখলেই স্পষ্ট যে, আলুর জোগান এ বারে খুবই ভাল। অন্য রাজ্যে রফতানি করলেও বাজারে ঘাটতি দেখা দেবে না। আর যেটুকু দাম বাড়ছে, সেটা বাজারে টান আছে বলেই। অর্থাৎ, একেবারেই অর্থনীতির নিয়মে। এই নিয়মকে জোর করে আটকাতে গেলে ক্ষতিই হবে অর্থনীতির।

কিন্তু ব্যবসায়ের এই সাধারণ নিয়মের দিকে কি নবান্ন আদৌ চোখ ফেরাবে? নাকি ১৪ টাকা কেজি দর বেঁধে আলু বিক্রির মতো সস্তা জনপ্রিয়তার পথ নিয়ে খুচরো ব্যবসায়ীদের পথে বসানোর ব্যবস্থা করে দেবে? এই প্রশ্নই এখন ব্যবসায়ী মহলে জোরদার হয়ে উঠেছে। যার জবাব কারও কাছেই নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন