প্রশান্ত প্রামাণিক ও বাদল ভট্টাচার্য
সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রভাবশালীদের খুঁজে বের করে তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে তদন্তে নতুন পদক্ষেপ করল সিবিআই।
এ বার জেরার জন্য সিবিআই তলব করেছে প্রশান্ত প্রামাণিক ও বাদল ভট্টাচার্যকে। সাধারণত প্রভাবশালী বলতে যা বোঝায়, এঁরা কেউই তা নন। কিন্তু বাদল ভট্টাচার্য প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ সোমেন মিত্রের ঘনিষ্ঠ। তাঁকে সোমেনবাবুর এক রকম ছায়াসঙ্গীও বলা চলে। আর তৃণমূল নেতা প্রশান্ত প্রমাণিক রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্রের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হিসেবে পরিচিত। শনিবার ওই দু’জনের সঙ্গেই যোগাযোগ করে সিবিআই তাঁদের ডেকে পাঠিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও কান টেনে মাথা আনার পন্থা নেওয়া হয়েছে বলে সিবিআই সূত্রের খবর।
দিল্লি থেকে সিবিআইয়ের মুখপাত্র কাঞ্চন প্রসাদ এ দিন জানিয়েছেন, তদন্তের স্বার্থেই প্রশান্ত প্রমাণিক ও বাদল ভট্টাচার্যকে জেরা করা প্রয়োজন। ওই দু’জনের সঙ্গে কথা বলে রাজ্য-রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কোনও চরিত্রের সারদা-যোগের বিষয়ে তথ্য মিলতে পারে বলে আশা করছে সিবিআই। সারদার ভরাডুবির আগে পর্যন্ত বাদলবাবুর ছেলে ওই গোষ্ঠীর একটি সংস্থায় চাকরি করতেন বলেও জেনেছেন তদন্তকারীরা।
অগস্টে গ্রেফতার হওয়া ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুর কাছ থেকে পাওয়া কিছু সূত্র যাচাই করতে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলা জরুরি বলে মনে করছে সিবিআই। কয়েক দিন আগে মন্ত্রী মদন মিত্রের প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক রেজাউল ওরফে বাপি করিমকেও ডেকে পাঠিয়ে জেরা করে তারা। এই বাপির মাধ্যমেই মদন-ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রশান্তবাবুর কথা জানা গিয়েছে বলে সিবিআই সূত্রের খবর।
তদন্তকারীরা জেনেছেন, সল্টলেকে মিডল্যান্ড পার্কে সারদা-কণর্র্ধার সুদীপ্ত সেনের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত ছিল প্রশান্তবাবুর। কেন তিনি সেখানে যেতেন, সেটা জানা তদন্তে জরুরি বলে সিবিআই মনে করছে। বাপি তদন্তকারীদের যা বলেছেন, সেটা যাচাই করে দেখতেও প্রশান্তবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চায় তারা।
মন্ত্রী মদনবাবুকে একদা প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের প্রশংসা করতে দেখা গিয়েছিল। সুদীপ্তবাবুর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল বলেও নানা শিবিরের দাবি। এর পরিপ্রেক্ষিতে মদনবাবুর ঘনিষ্ঠ প্রশান্তবাবুকে জেরা করাটা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন রাজ্য রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। উত্তর কলকাতার গৌরীবাড়ি এলাকার বাসিন্দা প্রশান্তবাবু অবশ্য আগে উত্তর কলকাতার তৃণমূল নেতা অতীন ঘোষের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত ছিলেন। বছর দশেক আগে মদনবাবু তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই প্রশান্তবাবু তাঁর কাছের লোক হয়ে ওঠেন। তৃণমূলের সাম্প্রতিক সাংগঠনিক রদবদলের আগে পর্যন্ত তিনি দলের যুব সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক পদে ছিলেন। এখন শাসক দলের সাংগঠনিক দায়িত্বে না থাকলেও প্রশান্তবাবুকে কার্যত মদনবাবুর ছায়াসঙ্গী হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শিবির। তাঁকে সিবিআই-এর দফতরে ডেকে পাঠিয়ে জেরা করতে চাওয়ার সঙ্গে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার কোনও সম্পর্ক আছে বলে অবশ্য প্রশান্তবাবু মানতে চাননি। তিনি বলেন, “কেন ডেকে পাঠিয়েছে জানি না। বিকেলে হঠাৎ সিবিআই-এর ইনস্পেক্টর বর্ধন পরিচয় দিয়ে এক জন ফোন করে ডেকে পাঠান। বিষয়টি যাচাই করে তবেই যাব।” প্রশান্তবাবু জানান, তাঁর বাড়ির ঠিকানাও জানতে চাওয়া হয়।
একদা প্রদেশ কংগ্রেসের পদাধিকারী এবং সোমেন মিত্র-ঘনিষ্ঠ বাদল ভট্টাচার্যকে ঠিক কী কারণে ডেকে পাঠানো হয়েছে, তা নিয়ে তদন্তকারীরা খোলসা করে কিছু বলছেন না। সোমেন মিত্র এ দিন বলেন, “একেবারে গোড়া থেকেই আমি সিবিআই তদন্ত চেয়ে আসছি। নিরপেক্ষ তদন্ত হোক, এটাই চাইছি!” তবে বাদলবাবুকে সিবিআই ডেকে পাঠানোয় তিনিও বিস্মিত। ২০১১ ও ২০১২-র বিভিন্ন সময়ে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের উদ্দেশে লেখা বিভিন্ন চিঠিতে সোমেন মিত্র নির্দিষ্ট ভাবে কয়েকটি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেও সারদার নাম একটি বারও উল্লেখ করেননি। এই প্রসঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের আগে এক সাংবাদিক বৈঠকে সোমেনবাবু বলেছিলেন, “ভুলক্রমে সারদার নাম বাদ পড়ে গিয়েছিল।”
সিবিআই সূত্রের খবর, কলেজ স্কোয়্যারের দুর্গাপুজো ও আমহার্স্ট স্ট্রিটের কালীপুজোয় সারদার বিজ্ঞাপন, ব্যানার এই সব ব্যবহার করা হয়েছিল। তাই পুজোর অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা বাদলবাবুকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। বস্তুত, এই দু’টি পুজোই সোমেনবাবুর পুজো বলেও পরিচিত। পুজোয় সারদার টাকা ব্যবহার প্রসঙ্গে সোমেনবাবু অবশ্য সরাসরি বলেছেন, “সব বিজ্ঞাপনের টাকাই চেকে নেওয়া হয়েছে। সব কিছুর স্বচ্ছ হিসেব আছে!” বাদলবাবুও জানিয়েছেন, ২০১১ ও ২০১২ এই দু’টি বছরেই কলেজ স্কোয়্যারের দুর্গাপুজো ও আমহার্স্ট স্ট্রিটের কালীপুজোয় সারদার হোর্ডিং-ব্যানার ছিল। কলেজ স্কোয়্যারে সারদা স্টলও দিয়েছিল।
তাঁর ছেলে সঞ্জয় ভট্টাচার্য ২০১১ সাল থেকে ২০১৩-র এপ্রিলে সারদা-কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়া পর্যন্ত সারদা কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড সংস্থায় চাকরি করতেন বলেও জানিয়েছেন বাদলবাবু। কংগ্রেসের একাংশের আবার মত, ওই সময়ে সোমেনবাবুর সঙ্গে বাদলবাবুও তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। তাই বাদলবাবুর সঙ্গে কথা বলে সিবিআই তৃণমূল ও সারদার যোগ নিয়েও তথ্য খুঁজতে পারে।
ইস্টবেঙ্গল কর্তা নিতুর সঙ্গে পরিচয়ের বিষয়টিও সোমেনবাবু বা বাদলবাবু কেউই অস্বীকার করছেন না। বাদলবাবু বলেন, “ইস্টবেঙ্গলের পুরনো সদস্য হিসেবে নিতুকে চিনি বই কী। তবে সারদা-কাণ্ডের ব্যাপারে আমায় কেন ডাকা হল, কিছুই বুঝছি না।” এ দিনই বাদলবাবুকে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই-এর দফতরে ডাকা হয়েছিল। তবে সোমবার তিনি সিবিআইয়ের দফতরে যাবেন বলে জানিয়েছেন বাদলবাবু।