সাংবাদিকদের ধিক্কার মিছিল। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র
কেউ পথে নেমে প্রতিবাদ জানালেন। কেউ বা বিবৃতি পাঠিয়ে। কবি, বিচারপতি, অভিনেতা, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ— সকলেই তাতে সামিল। সাংবাদিকদের উপরে হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্বর ও সুরে মিলে গেল সোমবারের মহানগর।
সাংবাদিক-নিগ্রহের ঘটনায় এ রাজ্যে গণতন্ত্র বিপন্ন হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। এর জন্য রাজ্য প্রশাসনকে দায়ী করে তাঁদের দাবি, আগামী বিধানসভা নির্বাচন হোক কেন্দ্রীয় বাহিনীর আওতায়। এ দিন বেলা ৩টেয় কলকাতা প্রেস ক্লাব থেকে বেরিয়ে মেয়ো রোড, জওহরলাল নেহরু রোড, ডোরিনা ক্রসিং হয়ে ফের প্রেস ক্লাবে যায় সাংবাদিকদের প্রতিবাদ মিছিল। পরে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সম্পাদক অনিন্দ্য সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘যত দিন না রাজ্য সরকার নতজানু হচ্ছে, তত দিন এই প্রতিবাদ আন্দোলন চলবে।’’
ঠিক হয়েছে, সাংবাদিকদের উপরে শনিবারের হামলার ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্যপাল, রাষ্ট্রপতিকে আর্জি জানাবে প্রেস ক্লাব। ভোট লুঠ, সাংবাদিক-নিগ্রহের প্রতিবাদে ধর্মতলায় মিছিল করে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-ও।
দুপুরে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছিলেন বিশিষ্টজনেরা। সেখানে কবি শঙ্খ ঘোষ, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের স্বাক্ষরিত বিবৃতি পাঠ করেন অভিনেতা কৌশিক সেন।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাজ্য প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতেই গণতন্ত্রের উপরে আক্রমণ চলছে। পুর নিগমের নির্বাচনে নাগরিকেরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। পুলিশের সামনেই তাঁদের হেনস্থা করা হয়েছে। ২১ জন সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছেন। এই ঘটনা গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত ও বিপন্ন করেছে। বিবৃতিতে সই করেছেন অভিনেত্রী অপর্ণা সেন, পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, আবির চট্টোপাধ্যায়ও।
বাম জমানায় নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পরেও কৌশিক, অপর্ণা-সহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এ ভাবেই সরব হয়েছিলেন। পরিবর্তনের পরে এমন পরিস্থিতি নিয়ে কী বলছেন তাঁরা? কৌশিকের জবাব, ‘‘পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত ছিল। তা বলে এখন যা হচ্ছে, তার প্রতিবাদ করব না!’’ তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে মহামিছিল সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন তাঁরা। বলছেন, সেই সময় একটি নিরপেক্ষ জায়গা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ শাসক দলের ছাতার তলায় চলে গিয়েছেন। আর এক দল সরাসরি বিরোধীদের সঙ্গে রয়েছেন। তা হলে এখন নাগরিক সমাজ কী করবে?
কৌশিক বলেন, এটা রাজনৈতিক যুদ্ধ। নাগরিক সমাজ খুব বেশি কিছু করতে পারবে না। তার চেয়ে আগামী ভোট যাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নিরপেক্ষ ভাবে করা হয়, তার লড়াই চালাতে হবে। ‘‘প্রয়োজনে দিল্লিতেও যাব আমরা,’’ সঙ্কল্প কৌশিকদের।
সরকার ও শাসক দলের দ্বিচারিতার কথা তোলেন প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, সিন্ডিকেট করা যাবে না। আর তাঁর দলের লোকেরা বলছেন, সিন্ডিকেট না-করলে আয় করব কী করে? আসলে মুখ্যমন্ত্রীও লোক দেখানোর জন্য এ-সব বলেন।’’ শিক্ষায় নৈরাজ্য থেকে শিল্প-সঙ্কট পর্যন্ত সার্বিক সঙ্কটের জন্য উদ্বেগ তাঁর গলায়।
প্রশ্ন ওঠে, মুখ্যমন্ত্রী বারবার বিদেশ গিয়েছিলেন হিসেবে জ্যোতি বসু। কিন্তু তখনও তো শিল্প আসেনি?
অশোকবাবুর মন্তব্য, ‘‘তখন এত খারাপ অবস্থা ছিল না। এখন এখানে কে শিল্প গড়তে আসবে?’’ আর দুই জমানার সাংবাদিক-হেনস্থার তুলনা টেনে তিনি বলেন, বাম জমানায় সাংবাদিকেরা মার খেলে মন্ত্রীরা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এখন মন্ত্রীই প্রশ্ন তোলেন, সাংবাদিকেরা ভোটকেন্দ্রে কী করছিলেন?
এ দিন বামফ্রন্টের মিছিলে বিমান বসুরা সাংবাদিক-নিগ্রহের প্রতিবাদ জানান। বাগুইআটির এক সভায় বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যও সাংবাদিক-নিগ্রহের উল্লেখ করে বলেন, ‘‘এ রাজ্যে গণতন্ত্র বিপন্ন।’’