উমাকে ছাড়াই বোধন করলেন বৃদ্ধ অমরনাথ

মহালয়ার পরের দিনই বিসর্জন হয়ে গিয়েছিল শ্যামনগরের ঘটক বাড়িতে। মাটির প্রতিমার চোখে সে দিন সবে তুলির টান পড়েছে। মনটা বড় উচাটন ছিল বৃদ্ধ অমরনাথ ঘটকের। বাড়ির কর্তা। পাঁচ দশক ধরে তিনিই পূজারি।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:০৭
Share:

শ্যামনগরের ঘটক পরিবারের প্রতিমা।—নিজস্ব চিত্র

মহালয়ার পরের দিনই বিসর্জন হয়ে গিয়েছিল শ্যামনগরের ঘটক বাড়িতে।

Advertisement

মাটির প্রতিমার চোখে সে দিন সবে তুলির টান পড়েছে। মনটা বড় উচাটন ছিল বৃদ্ধ অমরনাথ ঘটকের। বাড়ির কর্তা। পাঁচ দশক ধরে তিনিই পূজারি। অমরনাথের পুজো দেখতে দূর দূর থেকে লোক ভিড় করে ঘটক বাড়িতে। পুজো করতে করতে প্রতিমার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান তিনি। কখনও কাঁদেন, কখনও নিজের হাতে ভোগ খাওয়ান ‘মা মা’ বলে। নিজের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পুজোরও বয়স বেড়েছে। নেই নেই করে ৩১৯ বছরে পড়ল এ বাড়ির পুজো।

কিন্তু এ বার তো সব কিছুই গণ্ডগোল হয়ে গেল!

Advertisement

অনেক সাধ করে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। পুত্রবধূকে বরণ করার সময় সদর দরজায় দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘‘পুজোর আগেই মা আমার ঘরে এল।’’ সে-ও প্রায় দেড় দশক আগের কথা।

১২ বছর আগে সেই নতুন বউয়ের হাতে পুজোর সব ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন বৃদ্ধ। বাবা-মা’র দেওয়া নাম দোলন। অমরনাথই নাম বদলে রেখেছিলেন উমা। দুর্গাপুজোর নাড়ু, তক্তি, ছাঁচের নানা মিষ্টি তৈরিতে উমা সিদ্ধহস্ত। ঘটক বাড়ির পুজো শ্যামনগরে সুপরিচিত। দুর্গার বাহন সিংহের এখানে ঘোড়া মুখ। তিনশো বছরের পুরনো ঠাকুর দালানে মাটির বেদি। সেই বেদিতেই পুজোর চারদিন দেবীর অধিষ্ঠান। মহালয়ার আগে থেকেই বেদি লেপে, মুছে, ঘরদোর পরিষ্কার করে রাখায় উমার জুড়ি মেলা ভার। একাই দশভূজার মতো সামাল দিতেন পুজোর উপাচার থেকে ভোগ রান্না। অমরনাথও পুত্রবধূর উৎসাহে নিশ্চিন্ত হতেন। ভাবতেন, তাঁর অবর্তমানেও পুজো চলবে ঐতিহ্য বজায় রেখে।

মহালয়ার তখনও দিন চারেক বাকি। আশ্বিনেও আষাঢ়ে বৃষ্টিটায় মনে কু ডেকেছিল অমরনাথের। ঠাকুর দালানটা লেপা-মোছা হয়নি। জল চুঁইয়ে মাটির বেদিতে কাদা জমেছে। উমা শয্যাশায়ী। জ্বর কমছে না। চারদিকে যে ভাবে ডেঙ্গি হচ্ছে, তাতে যে কোনও জ্বরেই চিন্তা বাড়ায়। ছেলে বিশ্বরূপকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলেও স্বস্তি পাননি। নিজেই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেন। মহালয়ার পরের দিন বারান্দায় বসেছিলেন বৃদ্ধ। ঠাকুরদালানে প্রতিমার চোখ আঁকছিলেন শিল্পী গৌতম পাল। অভিজ্ঞ হাত। মৃণ্ময়ীকে চিন্ময়ী করেন তুলির টানে। কিন্তু বাঁ চোখের মণিতে কালো রঙের তুলি বোলাতে গিয়ে সে হাতও আচমকা কেঁপে গিয়েছিল।

উমার জ্বর কমেছিল সে দিন। পুজোর প্রস্তুতিতে হাত লাগাতে চেয়েছিলেন। ঘরে রাখা জলের পাত্র থেকে গ্লাস ভরে জল খেতে গিয়ে আচমকা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন উমা। হাত থেকে জলভরা গ্লাস ছিটকে পড়তে দেখে বৃদ্ধ অমরনাথ বুঝে গিয়েছিলেন, সব শেষ। নিজেই নাড়ি ধরে বসেছিলেন খানিক্ষণ। বৃদ্ধ অমরনাথের কান্নার আওয়াজে পাড়ার অনেকেই জড়ো হয়েছিলেন একটু একটু করে।

৩১৮ বছর একটানা পুজো হয়েছে ঘটক বাড়িতে। ‘‘কখনও কোনও অমঙ্গল হয়নি। পুজো বন্ধ করতে হয়নি। তবে এ বার কেন এমন হলো?’’ বিড়বিড় করেন বৃদ্ধ। উমার মৃত্যুতে এত বছরের দুর্গাপুজো বন্ধ। অশৌচ চলবে, পুজো হবে না খবর ছড়ালো চারপাশে। পুরোহিত, শাস্ত্র, পাঁজি-পুঁথি দেখেও পুজো করার বিধান মিলল না। শিল্পী গৌতম অবশ্য থামেননি। একটু একটু করে প্রতিমার কাজ শেষ করেছেন। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন তাঁকে, কী হবে এই প্রতিমা? অন্য কেউ তো পুজো করবে না। গৌতম হেসেছেন। কৌতুক করেই বলেছেন, ‘‘আমাকে দিয়ে নিজেকে গড়িয়ে উমা কি আর আগেভাগে চলে যেতে পারবে? বিজয়া করেই যেতে হবে।’’

পঞ্চমীর সকালে ঘটক বাড়িতে এক এক করে জড়ো হয়েছেন পড়শিরা। বৃদ্ধ অমরনাথের কাছে আর্জি জানিয়েছেন, ‘‘পুজো বন্ধ করবেন না।’’ দিশাহারা অমরনাথ ছুটেছেন বেলুড়ে। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরাও পুজো করার কথা বলায় ভরসা পেয়েছেন। মনে মনে খানিক তৃপ্তি আর হাহাকারও। উমার স্পর্শ ছাড়াই ঠাকুর দালানে আলো জ্বলেছে। লেপা-মোছা হয়েছে, নাড়ু-তক্তিও তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রতিমার বোধন হয়েছে ঘটক বাড়িতে।

শুধু বৃদ্ধ আর এ বার পূজারি নন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement